Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

বাংলা নাটকের ধারায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের অবদান তুলে ধরো

ভূমিকা : বাংলা নাটকের ইতিহাস দীর্ঘদিনের, প্রায় দেড়শত বছরের। আরম্ভের আগেও যে আরম্ভ থাকে তারই প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলা নাটকের ইতিহাসে। বাংলাদেশের চিরকালের নাটক ‘যাত্রা’।নাটক বলতে আর যা বুঝায় তা আধুনিককালের সৃষ্টি। বাঙালি সংস্কৃতির ধারায় যাত্রার প্রভাব যখন প্রবল ও ব্যাপক তখনই উনবিংশ শতকের শেষের দিকে ইংরেজরা এদেশে থিয়েটারের প্রচলন করেন তাদের নিজস্ব ঢংয়ে। তারপর পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আসেন বাংলা নাটকের অমর পুরুষ মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্র। তারা বাংলা নাটকের অবদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। নিম্নে বাংলা নাটকের ধারায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের অবদান তুলে ধরা হলো:

সারগর্ভ : আধুনিক যুগের সূত্রপাতে যে সমাজচেতনা পরিলক্ষিত হয়েছিল তার স্বরূপ তৎকালীন লেখকদের রচনায় লক্ষণীয় । হিন্দু সমাজের বহুবিধ কুসংস্কার যে ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনকে ঘোরতর সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় নিপতিত করেছিল তা দূর করার জন্য এই সময়ের সমাজসচেতন লেখকগণ সাহিত্যসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। ফলে , বাংলা নাটকের প্রাথমিক ইতিহাসে রামনারায়ণ তর্করত্ন , মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ নাট্যকারের রচনায় সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকটি প্রতিফলিত করার চেষ্টা দেখা যায়। নিম্নে বাংলা নাটকের ধারায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের অবদান তুলে ধরা হলো:

মাইকেল মধুসূদন দত্ত : পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আসেন ৰাঙলা নাটকের অমর পুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্ত । যেমন কবিতার ক্ষেত্রে তিনি এসেছিলেন সকলকে চমকিত করে এবং রাশিরাশি সোনার ফসল ফলিয়ে গিয়েছিলেন , নাটকের ক্ষেত্রেও তিনি আসেন তেমনি করে।আসেন আর নাটকের সোনার ফসল ফলান । মধুসূদন ৰাঙলা সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন নাটক হাতে করেই । মধুসূদন অনেক কিছু করেছেন তীব্র ঝোঁকের বশে, অনেকটা বাজি ধরে। তার ছিলো অসামান্য প্রতিভা , তাই তিনি হঠাৎ করে দিগ্বিজয় করতে পেরেছেন । অন্যরা যা পারেন না অনেকদিন সাধনা করে , মধুসূদন তা করেন কলম হাতে নিয়েই । মধুসূদনের সময় নাটক লেখা হতো অনেক , এবং ভীষণ উৎসবের সাথে সেগুলো হতো অভিনীত । কিন্তু ও – সকল নাটককে তিনি মেনে নিতে পারেন নি নাটক বলে । তার চোখের সামনে ছিলো গ্রিক ও ইংরেজি মহৎ , নাট্যদৃষ্টিগুলো। তিনি তখনকার বাঙলা নাটকের দীনতায় দুঃখ বোধ করতেন।

মধুসূদন শর্মিষ্ঠা নাটকের শুরুতে সেকালের নাটকের গ্রাম্যতায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন । তিনি বলেছেন :

অলীক কুনাট্যরঙ্গে/ মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে

নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়৷

বাংলা নাটককে কুনাটকের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন মধুসূদন ; তৰে ৰাঙলার মঞ্চ আজো কুনাটকেরই দখলে।

মধুসূদন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের কাহিনী নিয়েছিলেন মহাভারত থেকে। মহাভারতে যযাতি ও শর্মিষ্ঠার কাহিনী রয়েছে। মধুসূদন সে – পুরানো গল্পকে নতুন কালের মতো করে পরিবেশন করেন । নাটকটি মিলনমধুর। এরপরে মধুসূদন লেখেন দুটি প্রহসন : ‘একেই কি বলে সত্যতা’, ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। প্রথম প্রহসনটিতে মধুসূদন বিদ্রুপের আঘাত করেন সেকালের বিপথগামী তরুণদের এবং দ্বিতীয়টিতে আঘাত করেন ভীমরতিগ্রস্ত বুড়োদের।

১৮৬০ – এ বের হয় মধুসূদনের দ্বিতীয় , অভিনব , নাটক ‘পদ্মাবতী’। তিনি শর্মিষ্ঠা নাটকের কাহিনী নিয়েছিলেন মহাভারত থেকে , পদ্মাবতীর কাহিনী নেন গ্রিক উপকথা থেকে । গ্রিক উপকথায় ‘প্যারিসের বিচার’ নামে একটি গল্প আছে । গল্পটি চমৎকার, সে গল্প থেকে কাহিনি নিয়েই মধুসূদন নাটকটি লিখেন। নাটকটির সংকটের কাহিনির সাথে হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যেরও মিল আছে। মধুসূদন এ – গ্রিক গল্পকে ভারতীয় রূপ দিয়ে লেখেন ‘পদ্মাবতী’।

তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক (১৮৬১)। এটি এক মর্মস্পর্শী ট্র্যাজেডি । উদয়পুরের রাজকন্যা কৃষ্ণকুমারীর জীবনের করুণ পরিণতি এর বিষয় । মধুসূদন এ নাটকের কাহিনীর বীজ পেয়েছিলেন টডের লেখা রাজস্থানের কাহিনী গ্রন্থে । মধুসূদন এ নাটকে পাশ্চাত্য ট্র্যাজেডির আদর্শ পুরোপুরি কাজে লাগান । এর কাহিনীকে এক বেদনাকরুণ রূপ দিয়েছেন মধুসূদন তাঁর নাটকে। কাহিনী যতোই এগিয়ে যায় , আমরা ততই এগিয়ে যাই বিষাদময় পরিণতির দিকে । নিজের ভাগ্যের জন্যে বিন্দুমাত্র দায়ী ছিলো না কৃষ্ণা । মধুসূদন তাকে এঁকেছেন সহজ সরল আকর্ষণীয় করে। তার মতো নিষ্পাপ মেয়ে যে এরকম পরিণতির মুখোমুখি দাঁড়াবে , তা নিয়তি ছাড়া আর কে বলতে পারে । তবে আমরা আর নিয়তিতে বিশ্বাস করি না৷

মধুসূদন এরপরে লিখেছিলেন আরেকটি নাটক ; নাম – মায়াকানন ( ১৮৭৪ ) । এটি বের হয় তার মৃত্যুর পরে। মধুসূদন যে বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।

দীনবন্ধু মিত্র : মধুসূদনের সাথেসাথে একজন দুঃসাহসী প্রতিভাবান নাট্যকার আসেন বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে । তিনি দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩)। তিনি অল্পায়ু ছিলেন, কিন্তু লিখেছিলেন অনেকগুলো নাটক। তাঁর প্রথম নাটকটি আলোড়ন জাগায় দারুণভাবে। তাঁর প্রথম নাটকের নাম -’নীলদর্পণ’ (১৮৬০)। প্রকাশের সাথে সাথে এটি সাহিত্য এবং সমাজে জাগায় আলোড়ন । এটি এক বিপ্লবী রচনা । তখন বাংলার গ্রামে গ্রামে নীলকরদের অত্যাচার চরমে উঠেছিলো। নীলকরদের অত্যাচার তিনি তুলে ধরেন এ – নাটক । নাটকটি প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে৷ এ – নাটকে তিনি নীলকরদের অত্যাচারে একটি পরিবারের ধ্বংসের কাহিনী বলেন । সে পরিবারটি নবীন মাধবদের । দীনবন্ধু তীব্র আবেগ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর নাটকে ।

বাংলা নাটকের প্রাথমিক ইতিহাসে রামনারায়ণ তর্করত্ন , মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ নাট্যকারের রচনায় সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকটি প্রতিফলিত করার চেষ্টা দেখা যায় । দীনবন্ধু মিত্রের হাতে এই শ্রেণির নাট্যসৃষ্টি ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে । সমাজের চিত্র রূপায়ণের উর্ধ্বে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস মানবমনের নিগুঢ় ব্যঞ্জনা প্রকাশেই তার প্রকৃত কৃতিত্ব প্রকাশমান । গতানুগতিক বাংলা নাটক ও প্রহসনে দীনবন্ধু মিত্র গঠনকৌশলের দিক থেকে কোন অগ্রগতি সাধন না করতে পারলেও তার নাটকে অঙ্কিত চরিত্রাবলী বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ । সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের বিচিত্র পরিচয় তিনি লাভ করেছিলেন বলে তাঁর রচনায় বাস্তব অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। ‘নীলদর্পণ’ নাটকটিতে নাট্যকারের প্রত্যক্ষ স্বজাতি – প্রেম এবং বিদেশী শাসকের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ উথাপিত হয়েছে৷ নীলকরেরা কি ধরনের অত্যাচার করত সে সম্পর্কে যোগেশচন্দ্র বাগল লিখেছেন , ‘ নীলকর কর্তৃক টাকা দাদন দিয়ে উৎকৃষ্ট জমিতে নীল চাষে চাষীকে প্ররোচনা , আশানুরূপ ফসল না হলে পর বছর নীল উৎপাদনে তাকে বাধ্য করান, নীল চাষের জন্য দশ বছরের চুক্তি , পুরুষানুক্রমে নীলকরের আজ্ঞাবহ প্রজায় পরিণতি, নীলকরদের জমিদারী তালুকদারী ক্রয় , প্রজাবৃন্দের দ্বারা বেগার খাটান , চুক্তি ভঙ্গকারী চাষীদের নীলকুঠিতে কয়েদ রাখা প্রভৃতি যত রকমের অত্যাচার উৎপীড়ন হতে পারে , নীলকরেরা নির্বিঘ্নে নীল চাষীদের ওপর তা করতে লাগল । নারী নির্যাতন , পারিবারিক সমহানি , নরহত্যা ইত্যাদি কাজও তারা করতে থাকে । বাস্তব চিত্র রূপায়ণের ফলে সে আমলে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রবল । আন্দোলনের সূত্রপাত হয় । ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচারে এদেশে কৃষকজীবনের দুর্বিষহ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষেত্রে এই নাটকটির গুরুত্ব অপরিসীম’।

‘নবীন তপস্বিনী’ ( ১৮৬৩ ) দীনবন্ধু মিত্রের দ্বিতীয় নাটক । এতে যে দুটি ভিন্ন কাহিনি স্থান পেয়েছে তা পরিপূর্ণভাবে মিশ্রিত হয় নি। ‘সধবার একাদশী’ ( ১৮৬৬ ) নামক প্রহসনে তৎকালীন ইয়ংবেঙ্গল দলের উথলতা ও অনাচারের চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। প্রহসনটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ অনুসরণে রচিত ।এতে গ্রাম্যতা ও রুচিবিকল্পতা থাকলেও তা গুরুত্বপূর্ণ রচনা । দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’ (১৮৬৭) নাটকটি রচনা হিসেবে সার্থকতা লাভ করতে পারে নি ।

দীনবন্ধু মিত্রের নাটকে মানবজীবনের সুখদুঃখ , আশা-আকাক্ষা , আচার-অনাচার প্রভৃতি ফুটে উঠেছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যে একটা স্বাভাবিকতাও রয়েছে । তিনি ভাষা ব্যবহারের দিক থেকেও বিভিন্ন । শ্রেণির লোকের বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেছেন । এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় , দীনবন্ধু মিত্র তাঁর নাটক রচনার মাধ্যমে বাংলা নাটকের ইতিহাসে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন ।

যবনিকা : রস-ভাব-ব্যঞ্জনা সহযোগে আনন্দদান নাটকের উদ্দেশ্য। নাট্যমঞ্চে অভিনেতা কর্তৃক নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে গতিশীল মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। নাটককে সমাজজীবনের দর্পণ বলা হয় এ কারণে যে, এতে নাট্যকার মানব জীবন চিত্রণের জন্য সমাজজীবন থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেন। আর বাংলা সাহিত্যের নাটকের ইতিহাসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্র সমাজজীবন থেকে মূল উপকরণ গুলো সংগ্রহ করে নাটক রচনা করেছিলেন। যা তাদের নাটককে মহীয়ান করে তুলেছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

সমর সেন এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সমর সেন (১০ অক্টোবর ১৯১৬ – ২৩ আগস্ট ১৯৮৭) ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাংলাভাষী কবি এবং সাংবাদিক, যিনি স্বাধীনতা-উত্তর কালের ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ

Read More

শওকত আলী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

শওকত আলী (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ – ২৫ জানুয়ারি ২০১৮) বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্মের জন্য

Read More

লােকসাহিত্য কাকে বলে?

লােকের মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা, কাহিনী, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি হলাে লােকসাহিত্য হলাে। লোকসাহিত্য মূলত বাককেন্দ্রিক। কেবল মৌখিক নয়, ঐতিহ্যবাহীও, অর্থাৎ লোকপরম্পরায় লোকসাহিত্য মুখে মুখে

Read More

সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করো!

সাহিত্য: ‘সাহিত্য’ শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে এসেছে। এখানে সহিত শব্দের অর্থ- হিত সহকারে বা মঙ্গলজনক অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পর্কে বলেন, “একের সহিত অন্যের মিলনের মাধ্যমই হলো

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.