বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যথার্থ আধুনিক উপন্যাসের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮ ১৮৯৪)। পাশ্চাত্য উপন্যাস ও রোমান্সের প্রভাবে তিনিই প্রথম আধুনিক বাংলা উপন্যাসের শিল্পসফল কাঠামো নির্মাণ করেন। বাঙালির জীবনকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের মিলনভূমিতে স্থাপন করে মননশীল সাহিত্য, কথাসাহিত্য প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালিকে উনবিংশ শতাব্দীর জীবনরস ও প্রাণবাণীতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। “ বাঙালির মনকে মননের দাঁড়া সুদৃঢ় করে সংস্কারকে যুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে , প্রাচীন ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করে , স্বাদেশিক মন্ত্রদীক্ষা দিয়ে , তিনি যে নতুন মানবতাবোধের পন্থা নির্দেশ করেন , এক শতাব্দীর বাঙ্গালি সেই পথ ধরেই চলেছে”। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাস পাঠ করলে বোঝা যায় যে, উপন্যাসটি ঐতিহাসিক রোমান্সে ভরপুর। নিম্নে রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’র মূল্যায়ন তুলে ধরা হলো:
বঙ্কিমচন্দ্রের অনেক উপনাসে ইতিহাসের প্রাধান্য থাকার কারণে অনেক সমালোচক এগুলোকে রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন । সমালাচকের এই মূল্যবান কতটুকু যথার্থ তা আমরা আলোচ্য নিবন্ধে মীমাংসা করার প্রয়াস পাব । তবে তার আগে রোমান্সের বৈশিষ্ট্য ও স্বরুপ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন ।
‘Romance’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বিস্ময়কর কল্পিত কাহিনী , উগ্ৰ ৰা অস্বাভাবিক প্রেমমূলক উপন্যাস অথবা ঘটনা। যে উপন্যাসে কাল্পনিক বা অস্বাভাবিক উগ্র প্রেমমূলক কাহিনী বিধৃত হয় তাকেই রোমান্সধর্মী উপন্যাস বলা হয় ।
রোমান্সেৱ বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ নির্দেশ করতে গিয়ে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার – ‘বঙ্গ সাহিত্যের উপন্যাসের ধারা’ গ্রন্থে বলেছেন , ‘Romance’- এর বাস্তবতা আপেক্ষাকৃত মিশ্র ধরণের ; ইহা জীবনের সহজ প্রবাহ অপেক্ষা তাহার অসাধারণ উচ্ছাস বা গৌরবময় মুহূর্তগুলির উপরে অধিক নির্ভর করে । অন্তরের বীরোচিত বিকাশগুলি, মনের উঁচুসুরে বাঁধা ঝঙ্কাৱগুলি , জীবনের বর্ণবহুল শোভাযাত্রার সমারোহ ইহাই মুখত রোমান্সের বিষয়বস্তু৷
আর এই বৈশিষ্ট্যের আলোকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ‘কপালকুণ্ডলা’ ( ১৮৬৬ ) কতটুকু সার্থক ও শিল্প সফল সৃষ্টি গ্রন্থ সমালাচনার আলোকে তার বিচার করার প্রয়াস পাব।
উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা উপন্যাসের তালিকায় ‘কপালকুণ্ডলা’ এক অভিনব শিল্পকর্ম । উপন্যাসটিতে রোমান্সের লক্ষণ প্রবল । মানব প্রকৃতির গুঢ়রহস্য এবং নিয়তিতাড়িত মানবভাগ্যের নিদারুণ পরিণাম দেখানো হয়েছে , কখনো কাব্যময় গীতি রসোচ্ছ্বাসের দ্বারা, কখনো সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক ছন্দে , কখনো বা নাটকীয় চমৎকারিত্বের দ্বারা ।
প্রকৃতি দুহিতা কপালকুণ্ডলা সামাজিক জীবন ও বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়ে এবং দুর্জ্ঞেয় নিয়তি নির্দেশ কীভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যু পরিণামের দিকে এগিয়ে গেল , কীভাবে তার স্বামী নবকুমার ঘটনাচক্রে অজ্ঞাতসারকে বেগমান করে তুলল , এই সমস্ত বিচিত্র কাহিনী ও চরিত্র উপন্যাসে অপূর্বভাবে বর্ণিত হয়েছে ।
দুর্গেশনন্দিনীর চেয়েও কপালকুণ্ডলার কাহিনী রোমহর্ষ। কাহিনীর স্থান – কাল – পাত্রে দুর্গেশনন্দিনীর কিছু ছায়াও পড়েছে। ইতিহাসের রাজপুত্রের রোমান্স এতে আছে । তবে মধ্যযুগের কাপালিক আর কপালকুণ্ডলার রোমান্স – আর এক ইতিহাসের সৃষ্টি করেছে । কাহিনীর দুটো স্রোত : ‘কাপালিক – কপালকুণ্ডলা – নবকুমার’ আর ‘সেলিম – মেহের – মতি’। দুটো স্রোতের দুটো উপন্যাস জমে ওঠেনি , রোমান্স জমে উঠেছে । বঙ্কিমচন্দ্র কপালকুণ্ডলা রচনার আগে প্রশ্ন করেছিলেন – “ যদি কোন মেয়ে ঘটনাচক্রে শিশুকাল থেকে ষোল বছর পর্যন্ত সমুদ্রতীরে বিজন অরণ্যে কাপালিক কর্তৃক পালিত হয় । — পরে যদি কেউ তাকে বিয়ে করে সমাজে নিয়ে আসে , তাহলে সমাজ সংসর্গে তার কতটা পরিবর্তন হবে”।
উত্তরে সঞ্জীবচন্দ্র বলেছেন –“ সেই মেয়ে নির্জনতা , আরণ্য প্রকৃতি আর কাপালিকের প্র ভাবে কিছুকাল একটা ঘোরের মধ্যে থাকবে । পরে সন্তানাদি হলে স্বামী পুত্রের প্রতি ভালবাসা জন্মালে বাল্যের প্রভাব মুছে যাবে , ক্রমে সে সমাজেরই একজন হয়ে উঠবে “। উত্তরটা বঙ্কিমের পছন্দ হয়নি । পছন্দ হলে এ কাহিনী নিয়ে একটা উপন্যাস হতে পারত , হয়নি বলে তা রোমান্স হয়েছে৷
কপালকুণ্ডলার ঘটনা উপস্থাপন – কৌশল দুর্গেশনন্দিনীর চেয়ে চিত্তাকর্ষক৷ শুরুতেই বুঝটিকাচ্ছন্ন দিগন্ত আর সাগরে দিকভ্রষ্ট যাত্রীদের মৃত্যুভয় পাঠকের মনোযোগ কেড়ে নেয়। যাত্রীদের জীবন রক্ষার্থে একাকী নবকুমারের বনে গমন দুঃসাহসিকতায় পরিপূর্ণ । যাত্রীরা চলে গেলে সাগর তীরবর্তী অরণ্যে নবকুমারের একাকী অবস্থা ‘ রবিনসন ক্রুশো’র কথা মনে করিয়ে দেয় । নির্জন বনে আলো দেখে নবকুমারের মনে হয় ভৌতিক ব্যাপার । সেখানে কাপালিকের সাথে তার দেখা হয় । কাপালিকের ভীষণ চেহারা আর বীভৎস ধর্মাচরণ দেখে পাঠকের লোম খাড়া হয়ে ওঠে । এখানে গোথিক নভেলের কথা মনে পড়ে যায় । কাপালিকের কুটির থেকে নবকুমার সাগরসৈকতে এলে একদিকে নীলসমুদ্র , অন্যদিকে অরণ্যানী — এই নৈসর্গিক শোভা তার চোখে বিস্ময়মিশ্রিত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। মূলত বঙ্কিমচন্দ্র কাব্যিক ভাষায় নিসর্গের যে চিত্র দিয়েছেন তা রোমান্সের সৃষ্টি করেছে । সে মুহূর্তে আরো বিস্ময়কর সৌন্দর্য উপস্থিত হয় নৈবকুমার দেখে – অপূর্ব রমণীমূর্তি । রমণী আর নবকুমার একে অপরকে বিস্ময়ের সাথে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর যুবতী রমণী বলে – “ পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ “।
নবকুমার পথ হারায় রোমান্সের রাজ্যে । শুধু নবকুমার নয় , লেখক পাঠক সবাই। লেখক বলেছেন- “ সাগরবসনা পৃথিবী সুন্দরী , রমণী সুন্দরী , ধ্বনিও সুন্দর : হৃদয়তন্ত্রী মধ্যে সৌন্দর্য্যের লয় মিলিত লাগিল”৷
এই সৌন্দর্য রোমান্সের জগতের । যুবতীকে দেখে নবকুমারের মনে হয়েছে – “ একি দেবী- মানুষী – না কাপালিকের মায়া মাত্র । নবকুমারের মতো পাঠকও প্রচণ্ড ঘোরের মধ্যে পড়ে। কাপালিকের পিছে পিছে নবকুমার চললে হঠাৎ পিঠে কোমল করস্পর্শ পেয়ে পেছন ফিরে দেখে- “ সেই : বন্য – দেবীমূর্তি । নবকুমারকে ‘পলায়ন কর’ বলে সে উধাও হয়। নবকুমার জানে না যে কাপালিক তাকে বলি দিতে নিয়ে যাচ্ছে । যুবতী এসে বলে- ” এখন পলাও! নরমাংস নহিলে তান্ত্রিকের পূজা হয় না! তুমি কি জান না ?
”একথা শুনে কাপালিক গর্জনের স্বরে বলে – ‘কপালকুণ্ডলা’? এই যুবতী কপালকুণ্ডলার ভেতর নবকুমারকে দেখে নারীত্ব এবং প্রেম জেগেছে । কেননা অন্যদেরকে বধ করার সময় তার এ প্রচেষ্টা ছিল না । এরকম পটভূমিকায় ফার্ডিনাড-মিরান্ডা , দুষ্মন্ত-শুকন্তলা– এদের মধ্যেও প্রেম জেগেছে । কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র কপালকুণ্ডলা নবকুমারের প্রণয়চিত্র শেক্সপিয়র ও কালিদাসের মতো দীর্ঘায়িত করেননি ; খুবই সংক্ষেপ করেছেন । কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কাপালিকের খড়গ চুরি করে এবং নবকুমারের লতাবন্ধন কেটে দিয়ে তাকে নিয়ে পলায়ন করে । কাপালিক উচ্চ বালিয়াড়ির শিখরে উঠে আকস্মিকভাবে পড়ে যায় । এখানকার সবগুলো ঘটনাই শ্বাসরুদ্ধকর এবং শিহরনমূলক ।
কপালকুণ্ডলা নবকুমার কে নিয়ে অধিকারীর কাছে আসে। অধিকারী তাকে বিয়ে, স্বামী , সংসার এসব বোঝায় । কপালকুণ্ডলা সমাজ সম্পর্কে একেবারে কিছুই জানে না , তা নয়। সে ভাষা জানে , ভাষা সমাজেরই দান । তাছাড়া অধিকারী , কাপালিক – এরাও তো সমাজ। নবকুমারের প্রাণ রক্ষায় তাকে অত্যন্ত চতুরা বলে মনে হয় । নবকুমারের সাথে বিয়েতে সে সম্মত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র কপালকুণ্ডলার হৃদয়- সৌন্দর্য এঁকেছেন , কিন্তু হৃদয়ের টানাপোড়নের চিত্র দেননি । শিশুকালে সে দস্যু দ্বারা অপহৃত হয়ে সাগরপাড়ে পরিত্যক্ত হলে কাপালিক তাকে বড় করে । সে বনবিহারিণী। নবকুমারের সাথে বিয়েতে সম্মত হতে তার ভেতর টানাপোড়ন হওয়া স্বাভাবিক একদিকে কাপালিক , সমুদ্র , অন্যদিকে নবকুমার । কিন্তু তা হয়নি ৷ কপালকুণ্ডলাকে নিয়ে নবকুমারের ভেতর কোনো দোটানার সৃষ্টি হয়নি । অধিকারীর কাছে কপালকুণ্ডলা সম্পর্কে যা শুনেছে তাই বিশ্বাস করেছে ।
নবকুমার আগে পদ্মাবর্তীকে বিয়ে করেছিল । পদ্মাবতীর বাবা সপরিবারে পাঠানদের হাতে বন্দি হয়ে মুসলমান হয় । ফলে নবকুমারের বাবা পদ্মাবতীকে পুত্রবধু হিসেবে গ্রহণ করেনি। পদ্মাবতীর প্রতি নবকুমারের একটা টান থাকা স্বাভাবিক , কিন্ত্র তা ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র কাহিনীতে অতিপ্রাকৃতের রোমান্স এনেছেন । দেবীর পাদোপরি অধিকারীর দেয়া বিল্বপত্র পড়ে যায় না বলে ধারণা করা হয় – নবকুমারের সাথে কপালকুলের বিয়ে শুভ । বিয়ের পরে কপালকুণ্ডলার দেয়া বিল্বপত্র পড়ে যায় বলে স্বামীর সাথে কপালকুণ্ডলার গমন অশুভ । কাহিনীর পরের অংশ এ অতিপ্রাকৃতকে সত্যে পরিণত করার জন্য যেন রচিত । মূলত এ ধরনের ইঙ্গিত রোমান্সের সহায়ক৷
রূপকথার রাজপুরের অবলীলাক্রমে রাক্ষসের হাত থেকে রাজকন্যা উদ্ধার করে দেশে চলার মতোই নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে নিয়ে দেশে চলে । কপাকুণ্ডলাকে শিবিকারোহণে পাঠিয়ে নকুমার চলে হেঁটে । ফলে সে পিছিয়ে পড়ে। পথিমধ্যে হঠাৎ এক ভগ্ন – শিবিকা দেখে তার আশঙ্কা হয৷ নবকুমার সেখানে কপালকুণ্ডলাকে খুঁজতে যেয়ে অসামান্য সুন্দরী মতিবিৰিকে পায় ; যার শিবিকা দস্যু হস্তে পড়েছি৷ মতিবিবি নবকুমারকে চিনতে পারে , কিন্তু নবকুম মতিবিবিকে অর্থাৎ পদ্মাবতীকে চিনতে পারে না । পদ্মাবতী তার স্ত্রী ছিল , তাকে চেনা অস্বাভাবিক ছিল না । কিন্তু লেখক মতির বেশভূষায় পদ্মাবতীর কোন চিহ্ন রাখে নি । এতে পাঠকের মনে কৌতুহল জাগে পদ্মাবতী কীভাবে মতিবিবি হল । এ কৌতূহল লেখক পরে নিবারণ করেছেন । এ ধরনের কৌশল মূলত রোমান্স রচয়িতার কৌশল ; পদ্মাবতীর বাবা সমাজচ্যুত হয়ে রাজকার্যে যোগ দিলে পদ্মাবতী আগ্রায় এসে রুপে – গুণে রাজধানীর অগ্রগণ্য ‘লুৎফ-উন্নিসায়’ পরিণত হয়। লুৎফ-উন্নিসা যুবরাজ সেলিমের অনুগৃহীতা । সেলিম মেহের-উন্নিসার প্রণয়াসক্ত । শের আফগানের সাথে মেহেরের বিয়ে হলেও তাদের প্রণয় অব্যাহত থাকে । লুৎফ-উন্নিসা চেয়েছিল সেলিমের প্রণয়িনী হিসেবে একমাত্র রানি হবে । কিন্তু তা সম্ভব নয় বলেই সে যড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়, সেলিমের পুত্র খসরুকে সিংহাসনে বসাতে চায় । এজন্য সে উড়িষ্যায় যায়। পথেঘাটে সে নিজেকে মতিবিবি বলে পরিচয় দেয় । মতিবিবির ছদ্মবেশ এবং ষড়যন্ত্র রোমান্সের পরিচায়ক৷
উড়িষ্যা থেকে ফেরার পথে নবকুমারের সাথে তার দেখা হয় । পথিমধ্যেই সে খবর পায় ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে । সেলিম ‘সম্রাট জাহাঙ্গীর’ হয়েছে । শেষ চেষ্টা হিসেবে সে মেহের – উন্নিসার কাছে যায় । উদ্দেশ্য , মেহের সেলিমকে বিস্মৃত হয়েছে কিনা। মেহের বলে- ” আত্মজীবন বিস্মৃত হই , তথাপি যুবরাজকে বিস্মৃত হইতে পারিব না “। ইতিহাসে শের আফগান নিহত হলে সেলিম মেহেরের পরিণয় হয়েছিল । বঙ্কিম এই রোমান্টিক প্রণয়ের ইঙ্গিত দিয়ে রোমান্সের সৃষ্টি করেছেন৷ সেলিম , মেহের এসব চরিত্রের কোনো বিকাশ কিংবা অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা যায় না৷ মনে হয় এদের কাহিনীতে জোর করে আনা হয়েছে।
লুৎফ-উন্নিসা দীর্ঘদিন সেলিমের প্রণয়িনী ছিল৷ তখন একবারও তার ভেতর পদ্মাবতী জেগে ওঠেনি৷ নবকুমারকে কপালকুণ্ডলাসহ দেখে তার ভেতর পদ্মাবতী জেগে উঠল আশ্চর্যভাবে । সে যখন লুৎফউন্নিসা হয়েছিল তখন পদ্মাবতী যেন একেবারে মরে গিয়েছিল , আবার পদ্মাবতী যখন জেগে উঠল তখন লুৎফউন্নিসা মরে গেল । ” পদ্মাবতী আর লুৎফউন্নিসা- এই দুই সন্তার টানাপোড়েন হওয়া স্বাভাবিক ছিল , যেমন হয়েছিল শরৎচন্দ্রের রাজলক্ষ্মী আর পিয়ারীর মধ্যে । বঙ্কিমচন্দ্র তা না করে মতিবিবির ভেতর দুঃসাহস , তেজ , রহস্য- এসব এনে রোমান্সের মাত্রা বৃদ্ধি করেছেন৷
মতিবিবি রাজধানী ছেড়ে চলে আসে নবকুমারের সপ্ত – গ্রামে । এদিকে বিবাহিত জীবনে কপালকুণ্ডলার কিছু পরিবর্তন এসেছে। ননদ শ্যামাসুন্দরীর সাহচর্যে সে যোগিনী থেকে গৃহিণী হয়েছে । কপালকুণ্ডলার নাম মৃন্ময়ী রাখা হয়েছে । উপন্যাস সবে জমে উঠেছে । স্বামী তাকে ভালেবাসে , সুতরাং সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াই স্বাভাবিক । কিন্তু বঙ্কিম তাকে বন্ধনমুক্ত দেখালেন সে সমুদ্রতীরে বনে বনে বেড়াতে চায় তাহলে তো একটা দোটানার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক । একদিকে সংসারের বন্ধন , অন্যদিকে মুক্ত বনবিহারিণী জীবন । এ দ্বন্দ্বে ক্ষত – বিক্ষত হতে পারত মৃন্ময়ীর হৃদয় । মৃন্ময়ী যদি মা হতো , উঠতি বয়সের মেয়ের ক্ষেত্রে হওয়াটাই স্বাভাবিক , তাহলে স্বামী – সন্তানের বন্ধনে রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগে’র কুমুর বন্ধন যেমন হয়েছিল সন্তানের জন্য৷ কিন্তু লেখক তা করে নি।
শ্যামাসুন্দরীর স্বামীবশের ঔষধির ছল করে তাকে বনে আনা হয়েছে । এটা অস্বাভাবিক৷ শ্যামাসুন্দরী তাকে যেতে নিষেধ করেছে , নবকুমার মনঃক্ষুন্ন হয়েছে । তাছাড়া সে সমাজ অনভিজ্ঞ নয় , সে কুচরিত্রা , অবিশ্বাসিনী এসব শব্দের অর্থ বোঝে৷ নবকুমার একাকী বনে যেয়ে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল , অথচ সে কপালকুণ্ডলাকে দৃঢ়ভাবে নিষেধ করতে পারল না- তা কী করে সম্ভব ? মূলত সপ্তগ্রামের গৃহ থেকে কপালকুণ্ডলাকে রীতিমত জোর করেই সপ্তগ্রামের বনে আনা হয়েছে । ফলে আবার রোমান্স জমে উঠেছে । মতিবিবিকেও রীতিমত জোর করেই সপ্তগ্রামে আনা হয়েছে । সে নবকুমারের দাসী হতে চায়। নবকুমার মতিবিবির ধন – সম্পদ দেখে এবং মতিই যে পদ্মাবতী তা জেনেও কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি , এমন কি তার ভেতর কোন দোটানারও জন্ম হয়নি । লেখক তাকে আদর্শবান করে নির্মাণ করেছেন , ফলে সে রোমান্সের যথার্থ নায়ক হয়েছে ।
প্রত্যাখ্যাতা মতি ব্রাক্ষণকুমারের ছদ্মবেশ ধারণ করে বনে যায় । উদ্দেশ্য , কপালকুণ্ডলাকে অসতী দেখিয়ে নবকুমারকে পাবে। এ কাজ নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক সেই সাথে এটা নির্বুদ্ধিতারও পরিচয় বহন করে । চতুরা মতির এ ধরনের নির্বুদ্ধিতা অস্বাভাবিক। কিন্তু লেখক অস্বাভাবিককেই স্বাভাবিক করেছেন । আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ব্রাহ্মণকুমারের ছদ্মবেশে বনে যেয়ে কাপালিককে পায় । ভবানী কাপালিককে স্বপ্নে দেখিয়েছে সে যেন কপালকুণ্ডলাকে বলি দেয় । তারা দুজনে পরামর্শ করে । কপালকুণ্ডলা ঔষধি তুলতে এসে তাদেরকে আকস্মিকভাবে দেখতে পায় । ব্রাহ্মণকুমার কপালকুলাকে চিনতে পারে ; এতে কপালকুণ্ডলা শিহরিত হয় এবং পালিয়ে গৃহে আসে ।
রাতে সে ভীষণ স্বপ্ন দেখে তার এ স্বপ্ন রোমান্সের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে । ব্রাহ্মণকুমারের পত্র পেয়ে সে আবার বনে আসে। কপালকুণ্ডলার কবরীচ্যুত পত্র পেয়ে নবকুমার ও বনে আসে। মূলত সপ্তগ্রামের অরণ্যে আবার রোমান্স জমে ওঠে । কাপালিক নবকুমারকে ভবানীর আদেশ শোনায় এবং দূরে ব্রাহ্মণকুমার ও কপালকুণ্ডলাকে একত্রে দেখিয়ে কপালকুণ্ডলাকে অসতী বলে সন্দেহ করায় । তাছাড়া নবকুমারকে কাপালিক বলবৃদ্ধিকারক সুরা পান করায় । অলৌকিকভাবে কপালকুণ্ডলা ভবানীর আদেশ শুনে । সে ভবানীর পূজায় নিজেকে উৎসর্গ করতে চায় । বলি দেবার জন্য কাপালিক আর নবকুমার তাকে শশানে নিয়ে আসে । সেখানকার পরিবেশ অতি ভয়াবহ , শিহরনমূলক । মূলত সব ঘটনাতেই সেখানকার পরিবেশ অতি ভয়াবহ , শিহরনমূলক । মূলত সব ঘটনাতেই রোমান্সর ছড়াছড়ি ।
কাপালিকের নির্দেশে নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে স্নান করাতে নিয়ে যায় । পথে নবকুমারের নেশা কমে এলে । কপালকুলার জন্য তার রোমান্টিক প্রণয় উন্মোচিত হয়। সে বলে- “ তুমি অবিশ্বাসিনী নও – একবার বল , আমি তোমায় হৃদয়ে তুলিয়া গৃহে লইয়া যাই । কপালকুণ্ডলা বলে- “ আর আমি গৃহে যাইব না ” । এ রকম অবস্থায় , ওথেলোর কাছে ডেসডিমোনা প্রাণভিক্ষা চেয়েছে , ওথেলো দেয়নি । ডেসডিমোনার কাছে প্রিয়ের চেয়ে প্রাণ বড় হয়েছিল , কিন্তু কপালকুণ্ডলাকে নবকুমার বাঁচাতে চাইলেও , সে ভবানীর উদ্দেশ্যে নিজেকে বিসর্জন দিতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল ।
মূলত কপালকুণ্ডলা রোমান্সের অনন্য নায়িকা । তাকে সতী জেনে নবকুমার রক্ষা করতে যেয়ে পরিণামে উভয়েই অতল জলে নিমজ্জিত হয়েছে ফলে মেলোড্রামার সুর – “আমি মরিব” ধ্বনিত হয়েছে।
উপযুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় , চরিত্র নির্মাণ , গঠন কৌশল , ভাষার ওজস্বিতা, সাংকেতিকতা ও সাবলীলতা সব দিক দিয়েই এ উপন্যাস গুণেৱই আকর৷ বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে, সাবলীল গল্পে , রোমান্স সৃষ্টিতে ‘ কপালকুণ্ডলা ‘ শিল্পীর দ্বিধাহীন অপূর্ব সৃষ্টি । বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রোমান্সধর্মী উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’র হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক ধারার উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয় । যা পাঠক সমাবেশে এর ব্যাপক সাড়া মেলে । পাঠক তার মনের গহীনে লুকায়িত এক কিঞ্চিৎ ভাবাবেগের তৃপ্তির সন্ধানে যেন ‘কপালকুণ্ডলা’কে বেছে নেয় । এক্ষেত্রে , বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চিরায়ত রোমান্টিক ভাবধারাকে প্রকৃতি – সান্নিধ্য আবেশে পাঠকের সামনে হাজির করাতে সমর্থ হয়েছে ৷
সহায়ক গ্রন্থ :
১. আব্দুর রহিম, “বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস : রোমান্স প্রসঙ্গ”
২. মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (প্রকাশক), “বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাসমগ্র – ১ “
৩. বাংলা উইকিপিডিয়া