Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’- এর ঐতিহাসিকতা বিচার

বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ( ১৮২৪ – ১৮৭৩ ) সগৌরবে আবির্ভাব ঘটেছিল নাট্যরচনার সূত্র ধরে ৷  বাংলা নাটকের দীনহীন অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তিনি নাটক রচনায় আত্মনিয়োগ করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তার বিস্ময়কর প্রতিভা বৈচিত্র্যমুখী হয়ে ওঠে ৷  বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাট্যকার হিসেবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্থান সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ৷ তাঁর একটি বিখ্যাত নাটক হলো কৃষ্ণকুমারী। ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের কাহিনি টডের ‘রাজস্থান’ নামক গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত করা হয়েছে ৷  এই নাটকে মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক ট্রাজেডি রচনা করেন৷ এজন্য নাটকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ৷ ইতিহাসের কাহিনি অবলম্বনে লিখিত এটিই প্রথম বাংলা নাটক৷ নিম্নে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের ঐতিহাসিকতা বিচার করা হলো : 

ইতিহাসের কোন সুবর্ণময় আলোকিত অধ্যায় , সংঘাতময় ঘটনা বা কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে অবলম্বন করে ইতিহাসের তথ্যনির্ভর তৎকালীন রাজনৈতিক , সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমিকায় ইতিহাসের মর্যাদা ক্ষুন্ন না করে নাটকের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য সহযোগে নাটকীয় বিন্যাসে সৃষ্ট শিল্পকর্মকে ঐতিহাসিক নাটক বলা যেতে পারে ।

এক্ষেত্রে স্মরণীয় যে , ঐতিহাসিক নাটক এবং ইতিহাস এক বস্তু নয় । ঐতিহাসিক নাটকে ঐতিহাসিক চরিত্রের পাশাপাশি অনৈতিহাসিক চরিত্র থাকতে পারে , তবে সেক্ষেত্রে সব চরিত্রই ইতিহাসের সত্যতাকে পরিণতি দান করতে সচেষ্ট থাকবে। নাটকে ইতিহাসের সত্যতাকে অক্ষুন্ন রেখে শৈল্পিকভাবে নাট্যকার আপন উপলব্ধি বা জীবন দর্শনের প্রক্ষেপণ করতে পারেন । সর্বোপরি , তাকে নাটকের গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হতে হবে । এমন নাটক ও ইতিহাসের মেলবন্ধনে রূপায়ণই ঐতিহাসিক নাটক ।

মাইকেলের নাটকের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য ও গুণ এই যে , নাটকের আদি হতে অন্ত পর্যন্ত কাহিনীকে এক দৃঢ় সূত্রে সংবদ্ধ করা হয়েছে । এই ঐক্যের ( unity ) জন্য তিনি গ্রীক নাটকের কাছে ঋণী কিনা বলা যায় না , তবে একথা সত্য যে, মধুসূদনের পরবর্তী নাট্যকারদের নাটকে কাহিনীর এই জমাট ঐক্য খুব কম লক্ষ্য করা যায় । মধুসূদনের নাটকের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় অংশ একেবারে নাই বললেই চলে । পড়তে পড়তে আমাদের মন মূল ঘটনা হইতে কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না এবং কাহিনীও নিরবচ্ছিন্ন গতি প্রাপ্ত হয়ে পরিণতি লাভ করে।

কিন্তু কাহিনী দৃঢ়সংবদ্ধ ও গতিশীল হলেও মাইকেলের নাটক রঙ্গমঞ্চে কখনো জনপ্রিয় হয় নাই । এর কারণ তাঁর নাটকের মধ্যে নাটকীয় ভাব খুব কম । এই নাটকীয় (dramatic) ভাব না থাকলে কোনো নাটক রঙ্গমঞ্চে জমতে পারে না । আকস্মিক , অসাধারণ এবং অপ্রত্যাশিত বিষয়ের সমাবেশ না হলে এই নাটকীয় ভাব নাটকের মধ্যে সারিত হইতে পারে না ।

‘কৃষ্ণকুমারী’ মধুসূদনের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ট  নাটক । পূর্ববর্তী নাটক দুটিতে তিনি সংস্কৃত প্রভাব একেবারে বর্জন করিতে পারে নাই৷  কিন্তু ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে তিনি সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্ত্য রীতি অনুসরণ করে নাকি রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন।

প্রাচ্যনাট্যকলাবহির্ভূত বিয়োগান্তক নাটক রচনা করে তিনি তাঁহার স্বভাবসুলভ বিদ্রোহের পরিচয় দিয়াছিলেন । কৃষ্ণকুমারীই বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম ট্র্যাজেডি অর্থাৎ বিয়োগান্তক নাটক , সাধারণের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত আছে । ‘কৃষ্ণকুমারী’ শুধু মাত্র প্রথম সার্থক ট্রাজেডি নহে , এটি মধুসূদনের নাট্যপ্রতিভার প্রধানতম কীর্তি । শর্মিষ্ঠা ’ ও ‘ পদ্মাবতী ’ উভয় নাটকেই ছিল পুরাণের কাহিনী — একটিতে হিন্দু পুরাণের কায়া আর একটিতে গ্রীক পুরাণের ছায়া । কিন্তু পুরাণ পুরাণই, তাতে বাস্তব নরনারীর জটিল হৃদয়দ্বন্দ্ব বিকাশ করে দেখানোর অবসর নাই । নাট্যকারের হাত সেখানে সুবিদিত কাহিনীর রজ্জদ্বারা আবদ্ধ । সেজন্য এই দুইখানি নাটকে তিনি তার মৌলিক প্রতিভার লীলানৈপুণ্য দেখাতে পারে নাই ।

মাইকেল মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক শুধু নাট্যকারের নাট্যকীর্তির মধ্যে নয় , বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি টড বর্ণিত রাজপূতগণের ইতিহাস হতে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের কাহিনী গ্রহণ করে নাটকের প্রয়োজনে ইতিহাসের কিছুটা অন্য খাতে প্রবাহিত করলেও তিনি কোন ঘটনাকে বিকৃত বা পরিবর্তিত করেন নি । নাটকটিতে অনেক বেশি বিশ্বস্ততার সাথে ইতিহাসকে অনুসরণ করা হয়েছে ।

মধুসূদন রাজনারায়ণ বসুকে এক পত্রে লিখেছেন , টডের ইতিহাসে প্রথম খণ্ডের ৪৬১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত কাহিনী তিনি ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে গ্রহণ করেছেন । ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে পুনর্মুদ্রিত টডের প্রথম খণ্ডে এই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে । ( পৃ: ৩৬৫-৩৬৯ ) রাণ ভীমসিংহ ১৭৭৮-১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মেবারের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিল । সম্রাটরূপে তাকে যেরূপ ভাগ্যের বিপর্যয় বহন করতে হয়েছে তেমনি পিতারূপেও তাকে চরম দুঃখ পেতে হয়েছে ।

ষোড়শ বর্ষীয়া রাজকুমারী সুন্দরী কৃষ্ণাকে বিয়ে করার জন্য তিন সহস্র সৈন্যদলসহ জয়পুরের প্রতিনিধি দল উদয়পুরের রাজধানীর নিকটে শিবির স্থাপন করেছিল । মেবারের রাজনৈতিক অবস্থা তখন সংকটজনক । মহারাষ্ট্রীয়গণ বারংবার আক্রমণে ও লুণ্ঠনে দেশকে দুর্বল করে ফেলেছিল । চন্দ্রাবৎ ও শকাবৎগণের মধ্য বিরোধ , সামন্ত দলপতিগণের ক্ষমতালিপ্সা , প্রভূত অর্থের বিনিময়ে মহারাষ্ট্রীয় লুণ্ঠনকারীগণকে প্রশমিত করার প্রয়াস মেবারকে নিস্তেজ করেছিল । কুমারী কৃষ্ণাকে লাভ করার জন্য জয়পুর রাজের উপঢৌকন রাজা গ্রহণ করেছিলেন ।

কিন্তু মরুদেশীয় রাজা মানসিংহ তার পূর্ববর্তী মৃত রাজা বীরসিংহের বাগদত্তা বধূরূপে কৃষ্ণাকে দাবি করে বসলেন । তার দাবি প্রত্যাখ্যাত হলে সে বাধা দেবে ও জয়পুরের রাজার সাথে কৃষ্ণার বিয়ে হতে দেবে না । কৃষ্ণাকে নিয়ে যে বিবাদ তা কুমারীর জীবনকে ধ্বংস করল । সিন্ধিয়ার অর্থনৈতিক দাবি জয়পুর গ্রহণ না করায় সে মানসিংহের পক্ষ অবলম্বন করে। সিন্ধিয়া ভীমসিংহকে জয়পুরের প্রতিনিধিকে বিদায় দিতে নির্দেশ দেয় । কিন্তু তার দাবি অগ্রাহ্য হওয়ায় সে মানসিংহের সৈন্যদলসহ আপনার সৈন্যদল ও কামান নিয়ে আরাবল্লীতে গিরিবৰ্থে ঢুকে মেবারের বাইরে শিবির স্থাপন করে । ভীমসিংহ নিরুপায় হয়ে জগৎসিংহের প্রতিনিধিকে বিদায় দেয় । বিয়েতে বাধা দেওয়ায় জগৎসিংহ প্রতিশোধের জন্য বিপুল বাহিনী সজ্জিত করে । মানসিংহও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় । জগৎসিংহের প্রচুর সৈন্য ।

ইতোমধ্যে মানসিংহের বিরুদ্ধে সিংহাসনের একজন দাবিদার দাঁড়ায় । তার পক্ষ সমর্থন করে জগৎসিংহও পাঠান সর্দার আমীর খা কে । কিন্তু এই নতুন দাবিদার ধনকুলসিংহ আমীর খা – এর বিশ্বাসঘাতকতায় নিহত হয় । রাজা মানসিংহ যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং তার রাজ্য লুণ্ঠিত হয় । কিন্তু মেবারের সর্দারগণ রাঠোর বংশের অসম্মানে আহত হয়ে জয়পুর বাহিনীকে প্রতিআক্রমণ করে পর্যদস্ত করে । জগৎসিংহ অসম্মানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে প্রত্যাবর্তন করে । পাঠান সর্দার অজিত সিংহের সহযোগে ভীমসিংহকে প্রস্তাব পাঠালেন যে , হয় তিনি কৃষ্ণাকে মানসিংহের হাতে তুলে দেবেন অথবা কৃষ্ণার মৃত্যুর বিনিময়ে রাজওয়ারায় শান্তি স্থাপন করবেন । ভীমসিংহের সামনে দুটো পথ খোলা থাকল- রাঠোর রাজাকে খুশি করা বা পাঠানের রোষের বহ্নিতে মেবারের ধ্বংস প্রত্যক্ষ করা । বিনা অপরাধে নিস্পাপ কুমারী প্রাণ । বিসর্জন দিল।

কৃষ্ণার মৃত্যুর দায়িত্ব মহারাজা দৌলত সিংহকে দেওয়া হলে সে অসম্মতি জ্ঞাপন করে । তখন ভীমসিংহের পিতার উপপত্নীজাত পুত্র মহারাজ জওহন দাসের ওপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত হয় । কিন্তু কুমারী কৃষ্ণার নিস্পাপ চরিত্র ও রূপ প্রত্যক্ষ করে তার হাত হতে তরবারি খসে পড়ে । তখন পিতার আদেশ শুনে কৃষ্ণা হাসিমুখে বিষপাত্র গ্রহণ করে । সে মাকে জীব জীবনের অপরিহার্য পরিণাম মৃত্যুর কথা বর্ণনা করে তার শোক প্রশমিত করতে প্রয়াস পায় । তিনবার বিষপানেও তার মৃত্যু হয় না । অতঃপর তাকে কুসুমরস মিশ্রিত অহিফেন দেওয়া হয় । কৃষ্ণা মারা যায় ।

কৃষ্ণার মা খাদ্য পরিহার করে । নৈরাশ্যে ও মর্মভেদী দুঃখে শীঘ্রই কৃষ্ণার মা মারা যায় । মধুসূদন ইতিহাসে বর্ণিত ঘটনাসমূহ পরিবর্তিত বা বিকৃত না করে সম্পূর্ণ গ্রহণ করেছেন । উদয়পুরের দুরবস্থা ভীমসিংহের বর্ণনায় মেলে – “ দেখ আমার ধনাগার অর্থশূন্য , সৈন্য বীরশূন্য ৷ ” মহারাষ্ট্রের অধিপতি ত্রিশ লাখ মুদ্রার বিনিময়ে প্রত্যাবর্তনের আশ্বাস দিলেও ধনের অভাব ঘটলে পুনরাগমন ঘটিয়েছে।

উদয়পুরে বার বার আক্রমণের নিশ্চিত সম্ভাবনা হেতু ভীতি , কুমারী কৃষ্ণার বিয়ে উপলক্ষে জয়পুর ও মরুদেশের দ্বন্দ্ব , মহারাষ্ট্রীয় দল কর্তৃক বিপর্যয় সৃষ্টির সম্ভাবনা , জয়পুরের রাজদূতকে বিদায় দেওয়ায় জগৎসিংহের ক্রোধ , মানসিংহের বিরুদ্ধে ধনকুলসিংহকে সমর্থন ও উভয় দলের সম্মিলিত সৈন্যদলসহ উদয়পুর আক্রমণের আয়োজন , মানসিংহের পক্ষে আমীর খাঁ ও মহারাষ্ট্রপতি মাধবজীর যোগদান ইতিহাসে বর্ণিত এই তথ্যসমূহ মধুসূদন তার নাটকে যথাযথরূপে সংস্থাপন করেছেন।

ইতিহাসে আছে – পাঠান সর্দার আমীর খাঁ ও অজিতসিংহ হয় মানসিংহের সাথে কৃষ্ণার বিয়ে , না হয় তার প্রাণনাশের দাবি জানিয়েছিল । কিন্তু নাটকে আমীর খাঁর ও মানসিংহের যোগাযোগের পক্ষে কথা আছে , কিন্তু তার সাথে কৃষ্ণার বিয়ে , না হয় মৃত্যুর দাবির কথা নেই । নাটকে একটি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পত্রে কৃষ্ণার মৃত্যুর কথা আছে । বলা আছে, না চেষ্টা ও পরে অহিফেন খেয়ে মৃত্যু । কিন্তু নাটকে রাণী পদ্মিনীর অশরীরী রানির আহ্বানে। রাজকুমারী খড়গাঘাতে আত্মহত্যা করেছে ।

নাটকে ঐতিহাসিক চরিত্র তাদের নিজ নিজ পরিচয় ও সক্রিয়তায় স্থিত । ভীমসিংহ , কৃষ্ণা , মহিষী , জগৎসিংহ , সিন্ধিয়া , মানসিংহ , আমীর খাঁ , বীরসিংহ, ধনসিংহ প্রমুখ। কেবল কৃষ্ণাকে হত্যার জন্য ইতিহাসের জওহন দাস নাটকে বলেন্দ্ৰসিংহ নামে এসেছে । ইতিহাসে জগৎসিংহের উপপত্নীর নাম ছিল কপূর মঞ্জরী । নাটকে তার নাম দেওয়া হয়েছে বিলাসবতী । তাছাড়া তার চরিত্রে অভিমান ও ঈর্ষা সৃষ্টি করে তাকে নায়িকা বিপরীত । কোটিতে স্থাপন করা হয়েছে । 

বিলাসবতীর সখী মনিকা অনৈতিহাসিক চরিত্র । তাকে এনে শিল্পী নাট্যপ্রবাহে জটিলতা ও হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন । মনিকার কারণেই নাটকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজার যুদ্ধ হয় । কৃষ্ণার নামে লিখিত মদনিকার পত্র পেয়ে মানসিংহ কুমারী কৃষ্ণাকে বিয়ে করবার জন্য দূত পাঠিয়েছে । মনিকার কারণে জগৎসিংহ এবং মানসিংহের ভেতর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মনিকা যে দাবানল সৃষ্টি করেছে তা কল্পিত কাহিনী , কিন্তু উভয় রাজার মধ্যে কুমারীকে লাভ করবার আশায় যে সংঘর্ষ বেঁধেছিল তা টড বর্ণনা করেছেন ।

আবার মানসিংহের সাথে যবনপতি নবাব আমীর খাঁর আর মহারাষ্ট্রপতি মাধবজী যোগদান করে উদয়পুর রাজ্যে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করে । নাটকে মানসিংহের পক্ষ অবলম্বন করে মহারাষ্ট্র অধিপতি ভীমসিংহকে মানসিংহের কাছে কন্যা দানের কথা বলেছে । যে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পত্র নিয়ে কৃষ্ণার জীবনাবসান ঘটল , তার পরিচয় মধুসূদন আড়াল করলেও চিঠিটা ছিল নবাব আমীর খা কর্তৃক প্রেরিত ।

জগৎসিংহ সম্বন্ধে মধুসূদন লিখেছেন , তাকে তিনি ইতিহাস বর্ণিত নির্বোধ ও কামাসক্ত ব্যক্তিরূপে নাটকেও অঙ্কিত করেছেন । বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে , নাট্যকার তাকে মানবানুভূতিসম্পন্ন পরিপূর্ণ চরিত্ররূপে অঙ্কিত করেছেন । ভীমসিংহ ইতিহাস অনুগ গম্ভীর ও বিষাদাচ্ছন্ন প্রকৃতির চরিত্র । মহিষী গম্ভীর ও বিষাদে পূর্ণ চরিত্র , কুমারী কৃষ্ণা অভিজাত বংশের কোমল চরিত্র । বলেন্দ্ৰসিংহ চরিত্রে মানবিকতা সংযোজন করেছেন , তবে চরিত্রগুলো ঐতিহাসিক । মধুসূদনের হাতে বিশেষরূপে চিহ্নিত । নাটকে ধন্দাস নামে জগৎসিংহের অনুচর অনৈতিহাসিক চরিত্র । তার অর্থলোভের কারণে কৃষ্ণার চিত্রপট দেখার অবকাশ হয় জগৎসিংহের এবং ধনদাসই জগৎসিংহকে কৃষ্ণার পাণিপ্রার্থী হতে উদ্বুদ্ধ করে । ধনদাসের প্রতি মনিকার চ্যালেঞ্জই কাহিনীতে ঐতিহাসিক সংঘাতকে অনিবার্য করে ।

শিল্পী ধনদাস ও মনিকা নামক অনৈতিহাসিক অথচ নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রদ্বয়ে সৃষ্ট উপকাহিনীর মাধ্যমে মূল ঐতিহাসিক কাহিনীতে বর্ণিত সংঘাত ও পরিণতি নির্দিষ্ট হয়েছে। তাদেরই সক্রিয়তায় জয়পুর হতে সৃষ্ট ঘটনার ধারা উদয়পুর অভিমুখে শোকাবহ পরিণামের বীজ বহন করে প্রবাহিত হল । নারী রূপের প্রতি আকাঙ্ক্ষা , ধনলোভ , ঈর্ষা ও রাজমর্যাদা প্রতিষ্ঠার অহমিকা এই বিচিত্র প্রবৃত্তিসমূহকে একত্রিত করে এক স্রোতমুখী করে নাটকে গতি সঞ্চার করা নাট্যকারের সার্থকতার বিশেষ মাত্রা । তবে তপস্বিনী চরিত্র- অনৈতিহাসিক । চরিত্রটি বিবেক বা কোরাসের ভূমিকা পালন করেছে মাত্র ।

উপযুক্ত ইতিহাসের তথ্য , নাটকের কাহিনীবিন্যাস , চরিত্র নির্মাণ , কাহিনীর পরিণতি সবই কৃষ্ণকুমারী নাটকে ঐতিহাসিক নাটকের অবয়ব ও শর্তানুকূলে । ফলে সর্বদিক বিচারে ‘ কৃষ্ণকুমারী ’ ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে সফল ও সার্থক । যেহেতু এর পূর্বে বাংলা নাট্যসাহিত্যে কোন ঐতিহাসিক নাটকের সৃষ্টি হয় নি , ফলে এটিই প্রথম সার্থক বাংলা ঐতিহাসিক নাটক ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. অজিত কুমার ঘোষ, “বাংলা নাটকের ইতিহাস”

২. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, “মধুসূদন : কবি ও নাট্যকার”

৩. মাইকেল মধুসূদন শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র

৪. সৌমিত্র শেখর, “বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা”

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

লােকসাহিত্য কাকে বলে?

লােকের মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা, কাহিনী, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি হলাে লােকসাহিত্য হলাে। লোকসাহিত্য মূলত বাককেন্দ্রিক। কেবল মৌখিক নয়, ঐতিহ্যবাহীও, অর্থাৎ লোকপরম্পরায় লোকসাহিত্য মুখে মুখে

Read More

সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করো!

সাহিত্য: ‘সাহিত্য’ শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে এসেছে। এখানে সহিত শব্দের অর্থ- হিত সহকারে বা মঙ্গলজনক অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পর্কে বলেন, “একের সহিত অন্যের মিলনের মাধ্যমই হলো

Read More

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.