Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

সমাজবাস্তবধর্মী প্রতিবাদী নাটক হিসেবে দীনবন্ধু মিত্রের‘ নীলদর্পন’ নাটকের মূল্যায়ন

বাংলা সাহিত্যে নাট্যধারার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত হলেও বাংলা নাটকের অন্যতম রূপকার ছিলেন দীনবন্ধু মিত্র(১৮২১-৭৩)। বাংলা সাহিত্যে কবিতা-গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি নাটকও মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি সময় দীনবন্ধু মিত্র তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে প্রশংসা অর্জন করেছেন। ভারতীয় বাঙালী এই কবি ও নাট্যকার ব্রিটিশের নাগরিকত্বও লাভ করেন। তিনি রায়বাহাদুর পুরস্কারে ভূষিত হন। দীনবন্ধু মিত্র সেই বাস্তবতার চিত্রপট নিয়েই নাটক রচনা করেছেন, যা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে প্রশংসার শিখরে। দরদী মানুষের মুখের কথা তো লেখকই তুলে আনবেন, এটাই সমাজের প্রত্যাশা। সমাজের প্রত্যাশা পূরণ হলে সমাজ তাঁকে ছুড়ে ফেলে না দিয়ে বুকের ভেতর খোদাই করে রাখে। তেমনি একটি সাহিত্যকর্ম ‘নীলদর্পণ’। ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০) বেনামীতে মুদ্রিত দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম নাটক।নাটকটির নাম ছিল ‘নীলদর্পণম নাটকম’ এবং বিজ্ঞপ্তিটি ছিল : ‘নীলকর-বিষধর-দংশনকাতর-প্রজা নিকর-ক্ষেমস্করেণ কেনাচৎ পথিকেনাভি প্রণীতম’। নাটকে নাট্যকারের নাম ছিল না। অনুমান করা হয় এটি ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন এবং অনুবাদের প্রকাশক হিসেবে নাম থাকায় পাদ্রী রেভারেন্ড লং রাজদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন।

‘নীলদর্পণ’ নাটকটির নামকরণের মধ্যে দিয়ে নাট্যকারের মনোভাব পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই আন্দাজ করে নেন । নীলদর্পণ এর দর্পন শব্দটির একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে । এই নাটকের ভূমিকার দিকে নজর করলে দেখা যায় , নাট্যকার বলেছেন- নীলকরনিক রকরে নীল দর্পন অর্পন করিলাম । এক্ষনে তাঁহার নিজ নিজ মুখ সন্দর্শন পূর্বক তাঁহাদিগের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা -কলঙ্ক তিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্তে পরোপকার শ্বেতচন্দন ধারণ করুণ , তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজাব্রজের মঙ্গল এবং বিলাতের মুখ রক্ষা ।এই বক্তব্যেই ‘দর্পণ ‘ শব্দের মূল অর্থ প্রকাশিত । নিজ নিজ মুখ সন্দর্শনপূর্বক ‘ এই শব্দবন্ধেই বলে দেওয়া হয়েছে আসল কথা । ইংরেজ নীলকরেরা নিজেদের অত্যাচারের কাহিনী , কুকর্ম এই নাটক রূপ দর্পণে দেখে বুঝুক তারা কি মহাপাতকের কাজ করেছে । এই নাটক আসলে তাদের প্রতিবিম্ব স্বরূপ । এই ‘ দর্পণ ‘ শব্দটির নানান অর্থব্যঞ্জনা ।

এই দর্পণে যারামুখ দেখবন তারা ইংরেজ , বিজাতীয় । এদেশের তারা কেউ নয় । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই কারণেই নাটকটি অনুবাদ করা হয় । তবে যাই হোক এই বিদেশী দুই ধরনের- অত্যাচারী , দুবৃত্ত নীলকর সাহেবরা আর দ্বিতীয় শ্রেণী মানবতাবাদী ভালো ইংরেজরা। এই ভালো ইংরেজদেরকেই এ দর্পণ সমর্পণ করেছেন নাট্যকার । সে কারনে অত্যাচারে র নিখুঁত চিত্র চাই । সেই চিত্র ; প্রতিবিম্ব দেখে যেন তারা নিজেরাই লজ্জিত হয় । তাদের শুভবোধ জাগ্রত হয় । এটিই ছিল নাট্যকারের মূল এ ছাড়া নাটকে উল্লিখিত প্রজাদের সংলাপ থেকে বোঝা যায় , নীলচাষের সম্পূর্ন বিলুপ্তি নয় , প্রজাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার বন্ধ করাই নাট্যকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ।

সেই কারণে দীনবন্ধু চরিত্রদের মুখ দিয়ে বারে বারে বলিয়েছেন গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার কথা প্রজারাই যদি গ্রাম ছেড়ে চলে যায় , তাহলে নীলচাষ করবে কারা । অতএব , ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থেই প্রজাপীড়ন বন্ধ করুক , এমনই বার্তা কৌশলে নাট্যকার দেন।

নাটকটির উল্লেখযোগ্য চরিত্র সমূহ হলো গোলক বসু,নবীনমাধব,রাইচরণ,তোরাপ,সাবিত্রী,সরলতা,ক্ষেত্রমণি ইত্যাদি। নিম্নে আমরা সমাজবাস্তবধর্মী প্রতিবাদী নাটক হিসেবে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের মূল্যায়ন করব :

দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ এ নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের চিত্র এতে অঙ্কিত হয়েছে। নাটকটিতে নাট্যকারের প্রত্যক্ষ স্বজাতি-প্রেম এবং বিদেশি শাসকের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।প্রাচীন সময় থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলার মাটিতে নীলচাষের সূত্রপাত ঘটে। প্রাচীন দ্রাবিড়দের মাঝেও নীলের ব্যবহার হতো। দ্রাবিড়রা সিন্ধু নদের তীরে বসবাস করত। প্রচলিত তথ্যমতে, এদেশেই নীল চাষের উৎপত্তি হয় বলে মনে করা হয়। ফরাসী বণিকরা ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্যের সুবাদে বিভিন্ন বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছিল। ১৭৭৭ সালে লুই বন্ড নামের একজন ফরাসী বণিক আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এদেশে নীলচাষ ও নীল ব্যবহারের সূত্রপাত ঘটায়।

পরবর্তীতে বেশি মুনাফার আশায় বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ নীলের কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে। যুক্তরাজ্যে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রখাতে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হয়। এর কারণে নীলের চাহিদাও বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় নীলব্যবসা মুনাফার মুখ দেখতে শুরু করে। কিন্তু নীলচাষের ফলে এদেশের মানুষের বেশ অসুবিধাও সৃষ্টি হয়। লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে অনেক হিন্দু সরকারী কর্মচারীকে জমির মালিক করে দেন। ইংরেজরা এই ভূস্বামীদেরকে তাদের নীল ব্যবসা প্রসারের পথে বাধা হিসেবে আখ্যায়িত করল। কেননা, জমিদারদের অধীনস্ত প্রজাকে দিয়ে নীলকররা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করাতে পারত না। ফলে নীল উৎপাদনে তারা হতাশার ছায়া দেখতে শুরু করে।

ব্রিটিশরা ১৮১৯ সালে অষ্টম আইন পাশ করে। ব্রিটিশ প্রতিনিধিগণ প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। তবুও তাদের সমস্যার সমাধান ঘটে না। কারণ জমিদারকে অধিকহারে সেলামি ও খাজনা দিতে হত। বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য জমিস্বত্ব পাওয়া যেত। সেই সঙ্গে দৈনিক মজুরির বিনিময়ে প্রজার সেবা পাওয়া যেত। কিন্তু এই খরচ ছিল তাদের জন্য ব্যয়বহুল। তারা চিন্তা করল, দূরবর্তী স্থান থেকে শ্রমিক আনলে খরচ তুলনামূলক কম হবে। কিন্তু সেটিও আশানুরূপ ফলপ্রসূ হয়নি। পরবর্তীতে, ইংরেজরা চৌকস বুদ্ধির পরিচয় দেয়। ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ার সনদে চতুর্থ আইন বলবৎ করে। যাতে বলা হয়, এই আইনের দ্বারা এদেশে ইংরেজরা জমি ও জমিদারী ক্রয়ের সুযোগ পাবে। ফলে, অনেক জমিদার অধিক মূল্যের আশায় জমিদারী বিক্রি করে অন্যত্র চলে যায়। 

অন্যদিকে, অনেকে নীলকরদের বর্বরতার শিকার হয়েও জমিদারী হারায়। এভাবে ইংরেজগণ ধীরে ধীরে বাংলায় জেঁকে বসতে থাকে। তাদের ক্ষমতা সম্প্রসারণের জন্য নীলচাষের এলাকা বর্ধিত করে। যার কারণে কৃষকেরা তাদের উর্বর জমিতে শস্যের বদলে নীল বুনতে বাধ্য হয়। শুরু হয় কৃষকদের ওপর নীলকরদের অমানবিক অত্যাচার। কৃষকেরা নীল ব্যতীত অন্য শস্য উৎপাদন করতে পারত না। নীলকরদের কথা অনুযায়ী কাজ না করলে কৃষকের ওপর চালানো হতো অত্যাচার। ধীরে ধীরে নীলকররা বেশ শক্তিশালী ও বর্বর হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকরা ভয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে গেলে তাদের বসতভিটায়ও নীলচাষ করা হতো। আগুনেও পুড়ে দেওয়া হতো কারও ঘর-সংসার। কিন্তু অত্যাচারের পরিধি এত বেশি হয়ে উঠেছিল যে, কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হওয়া শুরু করল। এক সময় চাষীদের এই আন্দোলন বিদ্রোহে রূপান্তর লাভ করে। নীলচাষের বিরুদ্ধে শুরু হলো নীল বিদ্রোহ। নীলচাষীরা তাদের মৌলিক অধিকার ও নীলচাষ-আইন ব্যাহত করার জন্য নীল ব্যবসায়ী ও নীলকরদের বিপক্ষে প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে তোলে। নির্মম নিপীড়ন চাষীদেরকে বিষিয়ে তুলেছিল।

১৮৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে নীলচাষীরা ঐক্যবদ্ধভাবে নীলচাষের অস্বীকৃতি জানায়। তৎকালীন দি হিন্দু প্যাট্রিয়ট সংবাদপত্রে এই অত্যাচারের কথা তুলে ধরা হয়। জেনে যায় বিশ্বের দরোজা থেকে দরোজা। ভারতের নদীয়ায় (বাংলাদেশের যশোর জেলার চৌগাছা) সর্বপ্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়।

নীলদর্পণ নাটকে নবীনমাধবের নেতৃত্বে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে চিত্র অঙ্কিত তার সাথে কৃষ্ণনগরের নিকটস্থ চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের সংঘবদ্ধ সংগ্রামের সাযুজ্য লক্ষণীয় । বিষ্ণুচরণ একজন ছোট জোতদার ও দিগম্বর একজন ছোট মহাজন ছিলেন । নীলকরদের অত্যাচারের ফলে ক্রমশ তারা কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় । নীল দর্পণ  নাটকের লাঞ্ছিতা ক্ষেত্রমণির প্রসঙ্গটি এসেছে নদীয়ার এক কৃষক পরিবারের সুন্দরী কন্যা হরমণিকে হরণ করার প্রসঙ্গ থেকে । কেবল নদীয়ার জেলেই ৮৮৯ জন নীলচাষী নিক্ষিপ্ত হয়েছিল একাদশ আইনের ৫ নম্বর ধারায় । ‘নীল দর্পণ’ নাটকের গোলকবসুর কারাগারে নিক্ষেপ করার ঘটনা । তারই ইঙ্গিত দেয় । এ সময় নীলচাষীরা নানারকম ঘাত – প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আত্মসম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল । তাই তারা দলে দলে জেলে গিয়েছে বা আত্মগোপন করে থেকেছে কিন্তু নীলচাষ করতে রাজি হয় নি । চাষীদের এই দৃঢ় সংকল্পের কারণে সরকার বাধ্য হয়েই ১৮৬৮ সালে অষ্টম আইনের দ্বারা নীলচুক্তির নিয়ম বাতিল করে দেয়।  পরে বিদ্রোহটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। এরই ধারাবাহিকতায় নীলকরদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং ফাঁসিও দেওয়া হয়। কৃষকেরা নীলকরদের প্রতিহত করার জন্য প্রাণপণ লড়ে যায়। একপর্যায়ে নীলকরদের দমন করা সম্ভবপর হয়।

ঐতিহাসিক যোগেশ চন্দ্র বাগল বলেন, ‘কৃষকদের নীল বিদ্রোহের অহিংস আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহের চেয়ে বেশি সফল হয়।’ নীল বিদ্রোহ রোধ করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে ‘নীল কমিশন’ গঠন করে। আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে চাষীরা তাদের ন্যায্যতা ফিরে পায়। ১৮৬২ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান ঘটে। পরবর্তীতে, ১৮৯৫ সালে নীলকরেরা এই ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। নীলকরদের এই অমানবিক অত্যাচারের অধ্যায় নাটকের মাধ্যমে তুলে আনেন দীনবন্ধু মিত্র।নাটকটির ইংরেজী অনুবাদটি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে পাঠানো হয়। ব্রিটিশ শাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নীলদর্পণ। অনুবাদটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কারাদন্ড ও  জরিমানা করা হয় জেমস লঙকে। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার একটি বর্বর অধ্যায়ের যে সূত্রপাত ঘটেছিল তা অনেকাংশে সত্যতার হাতেখড়ি- নীলদর্পণ।

এই নাটকটি দীনবন্ধু মিত্রকে খ্যাতি ও সম্মানের চূড়াতে পৌঁছে দিলেও বাঙালী হৃদয়ে একটি নীলদাগ কেটে থাকে, যা কোনদিন মুছে যাওয়ার নয়। স্বদেশ চেতনার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই নাটকটি। সে সময়কার বাংলা সাহিত্য ও সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও সমাদৃত হয়। বাঙালীর মনে এর মমত্ববোধ ও দেশপ্রেমের ক্ষেত্রটা আরও বেশি মজবুত হয়েছিল। তৃণমূলধারার মানুষের মুখের কথা তুলে ধরে বিশ্বদরোজায় বিবেকের কড়া নেড়েছেন লেখক তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে। যেটি মানুষের ভিতরের অব্যক্ত কথা প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে। বর্তমান সমকালীন লেখকগণ বোধ করেন, নীলদর্পণ শুধু সেই সময়ের নাটক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেনি, বরং এই সময়েও নীলদর্পণ এর মতো নাটক আমাদেরকে সাহিত্যের উৎকৃষ্ট দরোজায় কড়া নাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কেননা, সাহিত্যের শিকড়কে কেন্দ্র করে সাহিত্যকর্ম এগিয়ে যায় সময়ের দাবি মেটাতে। আর সেই দাবি যদি লেখক হিসেবে পূরণ করা সম্ভব না হয় তবে সাহিত্য কিংবা সমাজের সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল। সুতরাং লেখককে আরও বেশি সজাগ হতে হবে সময় কি দাবি করছে?

বাঙালীর সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে কি ধরনের পরিপূরক প্রয়োজন তা লেখকদেরও খুঁজে বের করার প্রয়োজন আছে বলে বোধ করি। যে কারণেই দীনবন্ধু মিত্র তাঁর সমকালীন প্রেক্ষাপট নিয়েই সময়ের দাবি পূরণ করেছেন। নীলদর্পণ বাংলা সাহিত্যের একটি অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে ধরা হয়। কারণ বাংলা সাহিত্য বাংলার সমাজব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। আর সমাজব্যবস্থার মুখের কথাগুলো বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছাবে এটাই স্বাভাবিক। সেদিক থেকে বিবচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, নীলদর্পণ দীনবন্ধু মিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। এ বিষয়ে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘নীলদর্পণ নাটক প্রকাশিত হলে এবং এর ইংরেজি অনুবাদ প্রচারিত হলে একদিনেই এ নাটক বাঙালী মহলে যতটা প্রশংসিত হয়েছিল, শ্বেতাঙ্গমহলে ঠিক ততটাই ঘৃণিত হয়েছিল।’ মূলত: এই নাটকটির ফলেই ইংরেজরা নীলকরদের বর্বর চরিত্রগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিল।সমাজবাস্তবধর্মী প্রতিবাদী নাটক হিসেবে দীনবন্ধু মিত্রের নাটকটি সার্থক।কিভাবে গোলকমাধবের পরিবার নীলকরদের অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে গেল, সাধুচরণের কন্যা ক্ষেত্রমণির মৃত্যু হলো, সাধারণ কৃষকদেরকে সর্বহারা করা হলো এ সকল বিষয় নিদারুণভাবে নাটকে চিত্রাঙ্কিত হয়েছে তা বর্ণনাতীত। শুধু সাধারণ নয় ভদ্রলোকশ্রেণীর প্রতি ও চালানো হয়েছে নির্মম অত্যাচার। বলা হয়, দীনবন্ধু মিত্র কর্মসূত্রে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা রপ্ত করেছিলেন যা তিনি প্রয়োগ করেছেন তার নীলদর্পণে।

নাটকটি যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি সমালোচকদের চোখ এড়াতে পারেনি। কেননা, কোনো লেখকই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। সমালোচকেরা বলেছেন, এই নাটকে চরিত্রের দুটো দিক রয়েছে; অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। অভ্যন্তরীণ চরিত্রের আঞ্চলিকতার কারণে অন্তর্দ্বন্দ্ব খুব বেশি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায় না কিন্তু বাহ্যিক সংঘাতের ক্ষেত্রে কোনও চরিত্রই পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হতে পারেনি। নাটকের চিত্র ও দৃশ্যকল্পে জটিলতার যে রসায়ন তৈরি করা হয় তা প্রয়োগ না করার কারণে পাঠক কিংবা দর্শকমনে আগ্রহ বজায় রাখতে পারেনি। তৃণমূল মানুষের বাস্তবতা নিপুণভাবে তুলে ধরা হলেও উঁচুতলাশ্রেণির চরিত্রগুলোতে জড়তা ও কৃত্রিমতার ছাপ থেকে যায়। বিশেষ করে ট্রাজেডি রচনার ক্ষেত্রে সংযমী ও কৌশলী হতে হয়, কিন্তু এই নাটকে কোথাও কোথাও লেখক সে মাত্রা ছাড়িয়ে আতিশয্যের অবতারণা করেছেন। ফলে নাটকটি কোন কোন অংশে অতিনাটকীয় হয়ে পড়েছে। অথচ, তৃণমূল মানুষের জীবনের ব্যথা-বেদনা নিয়ে নাটকটি রচিত হয়েছিল বলে। 

অধিকাংশ মানুষ এটিকে দেশের প্রথম গণনাটক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। ইংরেজ-শক্তির বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল ঐক্যবদ্ধ এক শক্তির পাহাড়। যা বাঙালীদের নতুন ভোরের সূর্য দেখিয়েছিল।এতদসত্বেও নীলদর্পণ একটি সার্থক নাটক ও নীলকরদের অত্যাচারের দলিল হিসেবে বাংলার জনমানসে পরিচিত। অত্যাচারের চিত্র যেমনি ফুটে উঠেছে তেমনি প্রতিরোধের চিত্র ও আমরা লক্ষ্য করি,সেজন্য সমাজবাস্বধর্মী প্রতিবাদী নাটক হিসেবে নীলদপর্ণ নাটকটিকে আখ্যায়িত করতে পারি।

সহায়ক গ্রন্থ 

১. খোন্দকার সিরাজুল হক (সম্পা), “দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ”

২. বাংলা উইকিপিডিয়া

৩. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, “মাহবুবুল আলম”

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.