স্বর্ণকুমারী দেবী (২৮ আগস্ট, ১৮৫৫ – ৩ জুলাই, ১৯৩২) একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতকার ও সমাজ সংস্কারক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য মহিলা সাহিত্যিক হিসেবে তার ভূমিকা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তিনি শুধু সাহিত্যে নয়, সমাজ সংস্কারে তার অনন্য অবদানের জন্যও স্মরণীয় হয়ে আছেন।
পরিবার ও প্রথম জীবন
স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম কন্যা। তার চার দিদির মধ্যে প্রথমটি শিশু অবস্থায় মারা যায়। অন্য তিন দিদির নাম ছিল সৌদামিনী, সুকুমারী, ও শরৎকুমারী। ছোটোবোনের নাম ছিল বর্ণকুমারী। সৌদামিনী ছিলেন বেথুন স্কুলের প্রথম যুগের ছাত্রী, এবং অন্যান্য মহিলা সদস্যদের মতো স্বর্ণকুমারী দেবীও মূলত বাড়িতেই শিক্ষা লাভ করেন।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে শিক্ষার পরিবেশ ছিল বেশ উন্নত। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় উল্লেখ আছে যে, বিদ্যালয়ের তুলনায় বাড়িতে তারা অধিক শিক্ষালাভ করেছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবী তার অনুজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে ছয় বছর বড় ছিলেন।
বিবাহ ও সন্তানসন্ততি
১৮৬৮ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিবাহ হয় জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে। জানকীনাথ ছিলেন নদিয়া জেলার এক জমিদার পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। ঠাকুর পরিবারের পিরালী ব্রাহ্মণ বংশের সঙ্গে তার বিবাহ সম্পন্ন হওয়ায় জানকীনাথ পরিবারচ্যূত হলেও, তিনি ব্যবসা করে সাফল্য অর্জন করেন এবং নিজস্ব এক জমিদারি প্রতিষ্ঠা করে “রাজা” উপাধি লাভ করেন। তিনি ছিলেন একজন দিব্যজ্ঞানবাদী এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
জানকীনাথ ও স্বর্ণকুমারী দেবীর তিন সন্তান ছিল: হিরন্ময়ী দেবী (১৮৭০ – ১৯২৫), জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল (১৮৭১ – ১৯৬২), ও সরলা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭২ – ১৯৪৫)। জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পশ্চিম ভারতে কর্মরত ছিলেন।
সৃষ্টিকর্ম
স্বর্ণকুমারী দেবীর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুরুষ সদস্যদের মতো তিনিও সাহিত্যে একাধারে সৃজনশীলতা প্রকাশ করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সময় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন এবং তাকে সাহায্য করেছিলেন অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ। জানকীনাথ ইংল্যান্ডে গেলে স্বর্ণকুমারী দেবী জোড়াসাঁকোয় এসে থাকতে শুরু করেছিলেন এবং এখানেই তিনি নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
প্রথম উপন্যাস
১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস “দীপনির্বাণ” প্রকাশিত হয়। হানা ক্যাথরিন মুলেনস তার “ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত” প্রকাশ করে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত হলেও, স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক। “দীপনির্বাণ” ছিল জাতীয়তাবাদী ভাবনায় অনুপ্রাণিত একটি উপন্যাস। এরপর তিনি একাধিক উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন।
১৮৭৯ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা গীতিনাট্য (অপেরা) “বসন্ত উৎসব” রচনা করেন, যা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা সার্থকতর গীতিনাট্য রচনায় প্রভাবিত হয়েছিল।
ভারতী
১৮৭৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পারিবারিক পত্রিকা “ভারতী” চালু করেন। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথ সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এরপর একাদশ বছর স্বর্ণকুমারী দেবী পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পত্রিকার স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন।
ভারতী পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হত এবং এর ভাষা ছিল সহজ সরল। পত্রিকাটি বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যারাও কিছু সময়ের জন্য পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছিলেন। পত্রিকাটি প্রায় অর্ধশতাব্দীকালব্যাপী প্রকাশিত হয়।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি নিজেও সামাজিক সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৯ ও ১৮৯০ সালে পণ্ডিতা রামাবাই, রামাবাই রানাড ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নেন। তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
সখীসমিতি
১৮৯৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী “সখীসমিতি” স্থাপন করেন, যা অনাথ ও বিধবাদের সহায়তার উদ্দেশ্যে কাজ করত। সখীসমিতি অসহায় অনাথ ও বিধবাদের সাহায্য করার জন্য বিশেষভাবে কাজ করত এবং তাদের শিক্ষা প্রদান ও স্বাবলম্বী করতে সহায়তা করত।
স্বর্ণকুমারী দেবী বেথুন কলেজে একটি বার্ষিক মেলার আয়োজন করেন, যেখানে দেশজ পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এই মেলা কলকাতার সমাজে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
১৯০৬ সাল পর্যন্ত সখীসমিতি সক্রিয় ছিল এবং পরবর্তীতে হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রয় এর দায়িত্ব গ্রহণ করে। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা হিরন্ময়ী দেবী এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে “হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রম” নামে পরিচিতি পায়।
রচনাবলি
স্বর্ণকুমারী দেবীর রচনা বিশাল ও বৈচিত্র্যময়। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে:
- দীপনির্বাণ (১৮৭৬)
- মিবাররাজ (১৮৮৭)
- ছিন্নমুকুল (১৮৭৯)
- মালতী (১৮৭৯)
- হুগলীর ইমামবাড়ি (১৮৮৮)
- বিদ্রোহ (১৮৯০)
- স্নেহলতা বা পালিতা (১৮৯২,১৮৯৩)
- কাহাকে (১৮৯৮)
- ফুলের মালা (১৮৯৫)
- বিচিত্রা (১৯২০)
- স্বপ্নবাণী (১৯২১)
- মিলনরাত্রি (১৯২৫)
তার নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- বিবাহ-উৎসব (১৮৯২)
- বসন্ত-উৎসব (১৮৭৯)
- রাজকন্যা
- দিব্যকমল
- দেবকৌতুক
- কনেবদল
- যুগান্ত
- নিবেদিতা
কাব্যগ্রন্থ হিসেবে তার রচনাসমূহ:
- গাথা
- গীতিগুচ্ছ
তিনি তিন শতাধিক গানের রচয়িতা ছিলেন, যা ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক সংখ্যা।
সম্মাননা
১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণকুমারী দেবীকে “জগত্তারিণী স্বর্ণপদক” দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯২৯ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন, যা তার সাহিত্যিক ও সামাজিক কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
স্বর্ণকুমারী দেবীর জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্য ও সমাজ সংস্কারে যে অমূল্য অবদান রেখেছে, তা যুগের পর যুগ পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে যাবে। তাঁর সাহিত্যিক সৃজনশীলতা ও সামাজিক সচেতনতা তাকে বাঙালি নারীর আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।