Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ (১৪ই অক্টোবর ১৯৩০ – ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১২) ছিলেন ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট লেখক। তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভা, কর্মপ্রবাহ, ও গভীর চিন্তাভাবনা বাংলা সাহিত্যের আকাশে একটি আলোকময় দিগন্ত সম্প্রসারিত করেছে। মুস্তাফা সিরাজ জন্মগ্রহণ করেন মুর্শিদাবাদের খোশবাসপুর গ্রামে। তাঁর প্রাথমিক জীবন ছিল একান্তই অভ্যন্তরীণ এক অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ, যা পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যকর্মে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে।

প্রথম জীবনে তিনি পলাতক কিশোরের মতো জীবন যাপন করেন। তিনি রাঢ় বাংলার লোকনাট্য “আলকাপের” সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছেন। তাঁর পিতার সঙ্গে বর্ধমানের নবগ্রাম রেল স্টেশনের কাছে ময়না গ্রামে বেশ কিছুদিন বাস করেন। গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে তিনি লেখালেখির প্রথম দিকের কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে বহরমপুর কলেজে ভর্তি হন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘প্রেমের প্রথম পাঠ’ গোপালপুরের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছিল।

কর্মজীবন

মুস্তাফা সিরাজের সাহিত্যকর্ম বিস্তৃত ও বহুমুখী। তাঁর পরিচিতি প্রধানত তাঁর গোয়েন্দা চরিত্র কর্নেল নীলাদ্রি সরকার এবং তাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসের জন্য। “ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু”, “ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন”, “তরঙ্গিনীর চোখ”, “জল সাপ ভালোবাসা”, “হিজলবিলের রাখালেরা”, “নৃশংস”, “রণভূমি”, “মাটি”, “উড়োপাখির ছায়া”, “রক্তের প্রত্যাশা”, “মানুষের জন্ম”, “মৃত্যুর ঘোড়া”, “গোঘ্ন”, “রানীরঘাটের বৃত্তান্ত” ইত্যাদি তার অসংখ্য ছোটগল্পের মধ্যে কিছু।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যশোদাজীবন বন্দ্যোপাধ্যায়, রতন ভট্টাচার্য, স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দীর সঙ্গে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন মুস্তাফা সিরাজ। তাঁর লেখায় তিনি রাঢ় বাংলার প্রকৃতি, মানুষের জীবন এবং সামাজিক বাস্তবতাকে অতি দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। “হিজলকন্যা” এবং “অলীক মানুষ” উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত হন।

কলকাতায় পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করার পর মুস্তাফা সিরাজ আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। তার জ্ঞান ও বিদ্যায় গভীরতা তাঁকে এক বিশেষ সাহিত্যিক অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব – এসব বিষয়ে তাঁর বিস্তৃত জ্ঞান ছিল।

সাহিত্যিক জীবন

মুস্তাফা সিরাজের লেখক সত্তা ছিল রাঢ়ের মাটির সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। তাঁর লেখায় মুর্শিদাবাদের পাশের জেলা বীরভূমের প্রকৃতি, জীবনযাপন এবং সমাজের অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণ রয়েছে। “তারাশঙ্কর” এবং “নীলঘরের নটী” উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যে বিশেষ একটি স্থান অর্জন করেন। “তৃণভূমি” এবং “উত্তর জাহ্নবী” উপন্যাসে সমাজের নির্দিষ্ট সময় ও বিশেষত্বকে বিশ্লেষণ করেছেন।

তিনি গোয়েন্দা চরিত্র কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের স্রষ্টা। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার একটি জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র, যাঁর শখ হলো প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং অপরাধ সমাধান করা। তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন কিশোরদের মাঝে। তাঁর গোয়েন্দা কাহিনীগুলি মূলত বড়দের জন্য হলেও কিশোরদের জন্যও অনেক লেখা হয়েছে। “কর্নেল সমগ্র” ১৭ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে এবং “কিশোর কর্নেল সমগ্র” ৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া, সিরাজ আরও একটি গোয়েন্দা চরিত্র ‘ইনস্পেকটর ব্রহ্ম’ সৃষ্টি করেন।

ভৌতিক গল্প

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলা সাহিত্যে ভৌতিক গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তাঁর ভৌতিক কাহিনীগুলি ছোটদের জন্য হলেও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও লেখেন। “আজমগড়ের অশরীরী”, “খুলি যদি বদলে যায়”, “হরির হোটেল”, “ভূতে-মানুষে”, “তিন-আঙুলে দাদা”, “সেই সব ভূত”, “ডনের ভূত”, “রাতের মানুষ”, “চোর বনাম ভূত”, “রাতদুপুরে অন্ধকারে” ইত্যাদি গল্পগুলি তার ভৌতিক সাহিত্যের প্রধান উদাহরণ।

পুরস্কার ও সম্মাননা

মুস্তাফা সিরাজের “অলীক মানুষ” উপন্যাসটি ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার, ভুয়ালকা পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য পুরস্কারসমূহে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত নরসিংহদাস স্মৃতিপুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার, সুশীলা দেবী বিড়লা স্মৃতি পুরস্কার, দিল্লির OUF সংস্থার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুরস্কার, শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, দীনেশচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।

তাঁর সাহিত্যের উপর ভিত্তি করে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যেমন ‘কামনার সুখ দুঃখ’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘শঙ্খবিষ’, দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় ‘নিশিমৃগয়া’, উত্তমকুমার অভিনীত ‘আনন্দমেলা’, এবং অঞ্জন দাশের পরিচালনায় ‘ফালতু’। এছাড়া, ‘মানুষ ভূত’ কাহিনী মঞ্চে দীর্ঘদিন ধরে অভিনীত হয়ে চলেছে।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলা সাহিত্যের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী লেখক। তাঁর কাজের গভীরতা, প্রসঙ্গবোধ, এবং শিল্পময়তা তাঁকে একটি বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর লেখায় মানুষের জীবন, সমাজের বাস্তবতা, এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও কল্পনাশীল উপাদানকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনবদ্য অবদান তাকে বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করেছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

চর্যাপদের রচনাকাল নির্ণয় কর? চর্যাপদের রচনাকাল সম্পর্কে পন্ডিতদের মতামত ব্যক্ত করো!

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের যে পুঁথিটি আবিষ্কৃত করেছিলেন তা বাংলা লিপিতে লেখা এবং তা বাঙালির লেখা বলে অনুমান করা হয়। চর্যার পুঁথিটি পুরানো, তবে রচনাকালের সমসাময়িক

Read More

চর্যাপদের ধর্মমত বা ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো! চর্যাপদ রচনার পরিপ্রেক্ষিত আলোচনা করো!

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। কতকগুলো গানের সংকলন হলো চর্যাপদ। ‘চর্যাপদ’ একটি বৌদ্ধ পারিভাষিক শব্দ। চর্যাপদ শব্দের অর্থ যা আচরণীয় ও অনাচরণীয়, পালনীয় ও

Read More

সুকুমার রায় এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সুকুমার রায় (৩০ অক্টোবর ১৮৮৭ – ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি শিশুসাহিত্যিক, যিনি ভারতীয় সাহিত্যে “ননসেন্স ছড়া”র প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত। তিনি একাধারে লেখক,

Read More

সমরেশ বসু এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সমরেশ বসু (১১ ডিসেম্বর ১৯২৪ – ১২ মার্চ ১৯৮৮) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক। তাঁর জন্মনাম সুরথনাথ বসু হলেও তিনি সমরেশ বসু নামেই পরিচিত।

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.