শওকত আলী (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ – ২৫ জানুয়ারি ২০১৮) বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর লেখালেখির ধরন এবং বিষয়বস্তু পাঠকদের মাঝে একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে সম্মানিত করে। তাঁর জীবন এবং সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
শওকত আলী ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ খোরশেদ আলী সরকার এবং মাতার নাম সালেমা খাতুন। শওকত আলী ছিলেন তাঁদের তৃতীয় সন্তান। ছোটবেলায় তিনি পরিবারের সাথে বিভিন্ন জায়গায় অভিবাসী হন, যা তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর ছোটভাই আবদুর রোউফ সরকার, বাংলাদেশের প্রখ্যাত প্রচ্ছদশিল্পী, যিনি ১৯৪৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন।
শিক্ষা জীবন
শওকত আলীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় শ্রীরামপুর মিশনারী স্কুলে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কলকাতায় আক্রমণ শুরু হলে তাঁর পরিবার রায়গঞ্জে ফিরে আসে। রায়গঞ্জে তাঁর মা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন এবং বাবা ডাক্তারি পেশা শুরু করেন। এখানেই তিনি রায়গঞ্জ করনেশন ইংলিশ হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে, দিনাজপুরের সুরন্দ্রনাথ কলেজে আই.এ. এবং বি.এ. অধ্যয়ন করেন। কলেজ জীবনকালীন সময়ে তিনি কমিউনিস্ট দলের সাথে যুক্ত হন এবং বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, যা তার লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছিল।
কর্মজীবন
শওকত আলীর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৫ সালে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে। পাশাপাশি, তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার নিউজ ডেস্কে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে দিনাজপুরের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫৯ সালে ঠাকুরগাঁও কলেজে বাংলা প্রভাষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে, তিনি জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষকতা করেন এবং জেলা গেজেটিয়ারের ঢাকার হেড অফিসে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি সরকারি সঙ্গীত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৯৩ সালে অবসরগ্রহণ করেন।
সাহিত্যকর্ম
শওকত আলীর সাহিত্যকর্মের শুরু নবম শ্রেণীতে পড়াবস্থায়। ভারত ভাগের পর কলকাতার বামপন্থীদের ‘নতুন সাহিত্য’ নামক পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। এর পর, দৈনিক মিল্লাত, মাসিক সমকাল, এবং ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর গল্প, কবিতা, এবং শিশুদের জন্য লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রধানত উপন্যাস এবং গল্পের জগতে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উপন্যাস
শওকত আলী বহু উপন্যাস রচনা করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
- পিঙ্গল আকাশ (১৯৬৩): একটি কাল্পনিক উপন্যাস যা সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন দিক অনুসন্ধান করে।
- যাত্রা (১৯৭৬): একটি সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস যা মানুষের মনোজগতের পরিবর্তনকে ফুটিয়ে তোলে।
- প্রদোষে প্রাকৃতজন (১৯৮৪): একটি ঐতিহাসিক কাহিনী যা বাংলা সাহিত্যকে নতুন দৃষ্টিকোণ দেয়।
- অপেক্ষা (১৯৮৪): একটি আধুনিক উপন্যাস যা ব্যক্তি এবং সমাজের মধ্যকার সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করে।
- দক্ষিণায়নের দিন (১৯৮৫): একটি ত্রয়ী উপন্যাসের প্রথম অংশ, যা ষাটের দশকের সমাজের পরিবর্তন তুলে ধরে।
- কুলায় কালস্রোত (১৯৮৬): এই উপন্যাসটি ‘দক্ষিণায়নের দিন’এর পরবর্তী অংশ, যা সমাজে আঘাতের পরিবর্তন তুলে ধরে।
- পূর্বরাত্রি পূর্বদিন (১৯৮৬): উপন্যাসের তৃতীয় অংশ, যা নতুন সময়ের আগের সময়টিকে ফুটিয়ে তোলে।
এই ত্রয়ী উপন্যাসের সম্পর্কে শওকত আলী বলেছিলেন, “ষাটের দশকের মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনার যে পরিবর্তন আসছে, সেটাই ‘দক্ষিণায়নের দিন’। ‘কুলায় কালস্রোত’ হচ্ছে পরিবর্তন যেখানে আঘাত করছে। আর ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ হচ্ছে নতুন সময়টি আসার একেবারে আগের সময়টি।” এই উপন্যাসগুলির মাধ্যমে তিনি ষাটের দশকে সমাজের পরিবর্তন ও নতুন চিন্তা-চেতনার অভ্যুত্থান ফুটিয়ে তুলেছেন।
গল্প
শওকত আলী তাঁর সাহিত্য জীবনে অসংখ্য গল্প রচনা করেছেন। কিছু উল্লেখযোগ্য গল্প হচ্ছে:
- উন্মুল বাসনা (১৯৬৮): একটি গল্প যা মানুষের অদম্য বাসনার বহি:প্রকাশ ঘটায়।
- লেলিহান সাধ (১৯৭৮): এটি একটি গভীর ও সৃজনশীল গল্প যা মানব মনস্তত্ত্বের বিভিন্ন দিককে উপস্থাপন করে।
- শুন হে লখিন্দর (১৯৮৮): একটি সাম্প্রতিক সামাজিক সমস্যা নিয়ে লেখা গল্প।
পুরস্কার ও সম্মাননা
শওকত আলীর সাহিত্যকর্মকে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮): বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি।
- হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৭): তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য সম্মাননা।
- অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩): সাহিত্যজগতে তাঁর বিশেষ অবদানকে সম্মানিত করে।
- ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬): ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’, এবং ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ উপন্যাসের জন্য।
- আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯): সাহিত্য জগতে তাঁর অবদানের জন্য।
শওকত আলীর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। তাঁর উপন্যাস, গল্প এবং অন্যান্য লেখা পাঠকদের চিন্তা ও অনুভূতির গভীরে প্রবাহিত হয়ে তাদেরকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করেছে। তাঁর মৃত্যু ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটে। শওকত আলী বাংলা সাহিত্য জগতের একটি অমূল্য রত্ন হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন।