Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

মদনমোহন তর্কালঙ্কার এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মদনমোহন তর্কালঙ্কার (জন্ম: ১৮১৭ – মৃত্যু: ৯ই মার্চ, ১৮৫৮) ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট বাঙালি পণ্ডিত, যিনি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে অমূল্য অবদান রেখেছেন। তাঁর কর্মজীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই প্রবন্ধে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবন, শিক্ষা, কর্মজীবন, সমাজ সংস্কারমূলক কাজ এবং তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।

জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জন্ম ১৮১৭ সালে নদীয়া জেলার বেথুয়াডহরী, নাকাশীপাড়ার বিল্বগ্রামে একটি হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর পিতা রামধন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ পণ্ডিত এবং পরিবারের শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগী ছিলেন। মদনমোহন শৈশব থেকেই পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর দুই সন্তান, ভুবনমালা এবং কুন্দমালা, পিতার শিক্ষা ও সংস্কারের ধারায় নিজেদের গড়ে তুলেছেন।

শিক্ষা জীবন

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিক্ষাজীবন ছিল অসাধারণ এবং সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সময় তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহপাঠী ছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় তাঁর গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি ছাত্রজীবনেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরপর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষার ভিত্তি সংস্কৃত ভাষায় মজবুত হওয়ায় তিনি পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন।

কর্মজীবন

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কর্মজীবন শুরু হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক হিসেবে। সেখানে তিনি সাহিত্য বিভাগের শিক্ষকতা করতেন এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে অবদান রাখেন। তাঁর লেখনী ও পাঠ্যপুস্তক রচনায় তিনি বিশেষভাবে মনোযোগী ছিলেন। ১৮৫০ সালে তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে ১৮৫৫ সালে মুর্শিদাবাদের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য তিনি সহকর্মী ও সমাজের কাছে সম্মানিত ছিলেন।

সমাজ সংস্কারক হিসেবে অবদান

মদনমোহন তর্কালঙ্কার শুধু একজন পণ্ডিতই নন, তিনি সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচিত। ‘হিন্দু বিধবা বিবাহ’ প্রথার প্রচলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৮৫৭ সালে প্রথম বিধবা বিবাহটি সম্পন্ন হয়, এবং এই বিবাহের জন্য পাত্র-পাত্রীর সন্ধান ও যোগাযোগে মদনমোহনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এছাড়াও, স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে তিনি একনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। ১৮৪৯ সালে বেথুন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মহিলা স্কুলে তিনি তাঁর দুই মেয়েকে ভর্তি করেন এবং বিনা বেতনে সেখানে শিক্ষাদান করতেন।

সাহিত্যকর্ম ও রচিত গ্রন্থাবলী

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষার বিকাশে এক বিশেষ অবদান রেখেছে। তিনি বাংলা ভাষায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য অসাধারণ শ্রম দিয়েছেন। তাঁর রচিত “শিশুশিক্ষা” গ্রন্থটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের “বর্ণপরিচয়” গ্রন্থের পূর্বে প্রকাশিত হয়, যা বাংলা শিশুশিক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। “শিশুশিক্ষা” গ্রন্থটির তিনটি ভাগে বিভক্ত এবং এর চতুর্থ ভাগটি “বোধোদয়” নামে পরিচিত।

তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “বাসবদত্তা” ও “রসতরঙ্গিণী”। এই গ্রন্থগুলি ছাত্রাবস্থায় রচিত হলেও, তা বাংলা সাহিত্যে অমূল্য রত্ন হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। “আমার পণ” নামে তাঁর একটি কবিতা এখনো বাংলাদেশে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর বিখ্যাত পংক্তিমালা যেমন “পাখী সব করে রব, রাতি পোহাইল” এবং “লেখাপড়া করে যে/ গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে” আজও পাঠ্যপুস্তকে ও সাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত।

মদনমোহন তর্কালঙ্কার ১৪টি সংস্কৃত বই সম্পাদনা করেছেন, যা তাঁকে একজন প্রাজ্ঞ সংস্কৃতজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • রসতরঙ্গিণী (১৮৩৪): এটি তাঁর ছাত্রাবস্থায় রচিত একটি মহাকাব্যিক গ্রন্থ যা বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার সূচনা করে।
  • বাসবদত্তা (১৮৩৬): এটি একটি সংস্কৃত নাটক যা মদনমোহনের কাব্যিক প্রতিভার পরিচয় বহন করে।
  • শিশু শিক্ষা – তিন খণ্ড (১৮৪৯ ও ১৮৫৩): এই গ্রন্থগুলি বাংলা শিশুশিক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

সাহিত্য ও সমাজে প্রভাব

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সাহিত্যকর্ম শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি সমাজের রূঢ় বাস্তবতা ও মানুষের অভাব-অভিযোগ নিয়ে লিখতেন, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলত। তাঁর লেখার ভাষা সহজ ও সরল হলেও তা ছিল গভীর ভাবপূর্ণ। তিনি সমাজের কুসংস্কার ও অনাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন এবং মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কর্মময় জীবনের শেষটা খুবই দুঃখজনক। ১৮৫৮ সালের ৯ই মার্চ, তিনি কান্দিতে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য ও সমাজ সংস্কারে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়। তবে, তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমে তিনি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।

তাঁর উত্তরাধিকার স্বরূপ আজও তাঁর রচিত পাঠ্যপুস্তক ও সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয়। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর চরিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবেন।

মদনমোহন তর্কালঙ্কার ছিলেন একাধারে পণ্ডিত, শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক এবং সাহিত্যিক। বাংলা ভাষার বিকাশে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাঁর রচনা ও সমাজ সংস্কারমূলক কাজ আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

প্রমথ চৌধুরী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান

Read More
সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান ও অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। গবেষণার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা এবং মানুষের

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.