জাহানারা ইমাম ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখিকা, শিক্ষাবিদ, এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ জননী হিসেবে পরিচিত। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্মের বিশদ পর্যালোচনা করতে হলে আমাদের তাঁর জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যুর পরেও তাঁর প্রভাব ও অবদান নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
জন্ম ও শৈশব
জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা থানার সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ছিল জুড়ু। তিনি একটি রক্ষণশীল বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং মাতা সৈয়দা হামিদা বেগম ছিলেন একজন গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই তিনি এক প্রতিভাবান শিশু ছিলেন, এবং তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরুটা হয়েছিল গ্রামের স্কুল থেকে। জাহানারা ইমাম ১৯৪২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
শিক্ষা
জাহানারা ইমাম তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরুতে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ১৯৪৫ সালে তিনি কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে ভর্তি হন, যেখানে থেকে তিনি ১৯৪৭ সালে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশভাগের পর, পরিবারের সঙ্গে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এখানে এসে তিনি ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৬৫ সালে এমএ পাশ করেন। এর মধ্যে ১৯৬১ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে ছয় মাস অবস্থান করেন। সেখানে তিনি শিক্ষা সংক্রান্ত একটি ডিগ্রি অর্জন করেন যা তাঁর শিক্ষকতা জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
কর্মজীবন
জাহানারা ইমামের কর্মজীবন শুরু হয় একজন শিক্ষিকা হিসেবে। ১৯৪৮ সালে তিনি ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। এরপর ঢাকায় এসে তিনি সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। পরে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং কিছু সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে অংশকালীন শিক্ষিকা হিসেবেও কাজ করেন।
রাজনৈতিক জীবন ও মুক্তিযুদ্ধ
জাহানারা ইমামের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হলো মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাঁর ছেলে শাফি ইমাম রুমী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন। এই ঘটনাটি জাহানারা ইমামের জীবনে গভীর দুঃখ ও অনুপ্রেরণার জন্ম দেয়। তাঁর ছেলে শহীদ হওয়ার কারণে তিনি “শহীদ জননী” হিসেবে পরিচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর স্বামী শরীফ ইমামও মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন এবং পরবর্তীতে মারা যান। এই সময়ে জাহানারা ইমাম শুধু একজন মাতা হিসেবে নয়, একজন নেত্রী হিসেবে উঠে আসেন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠা
১৯৯১ সালে গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী দলের আমীর ঘোষণা করার পর, দেশের বিভিন্ন স্থানে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্য বিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গঠিত হয় এবং একটি ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তোলা। ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ গণ-আদালতে গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
সাহিত্যকর্ম
জাহানারা ইমাম একজন প্রতিভাবান লেখিকা ছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অভিজ্ঞতাসমূহ। তাঁর লেখা “একাত্তরের দিনগুলি” মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনা এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া তিনি শিশু সাহিত্যেও অবদান রেখেছেন। তাঁর লেখা “সাতটি তারার ঝিকিমিকি”, “বিদায় দে মা ঘুরে আসি” ইত্যাদি শিশু সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
পুরস্কার ও সম্মাননা
জাহানারা ইমাম তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সমাজের জন্য অবদানের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার এবং রোকেয়া পদক।
মৃত্যু ও পরবর্তী প্রভাব
জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্রয়েটে সাইনাই হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু বাংলাদেশে একটি গভীর শোকের সৃষ্টি করে। ৪ জুলাই তাঁর মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয় এবং ৫ জুলাই তাঁকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
সমাপ্তি
জাহানারা ইমাম ছিলেন একজন মহান নেতা, মা, এবং সাহসী লেখিকা। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মানবাধিকারের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তাঁর লেখাগুলি আমাদের ইতিহাসের একটি অমূল্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলী ও সাহস আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে রয়ে গেছে।