কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই, ১৮৯৭ – ৯ অক্টোবর, ১৯৮১) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি পরিসংখ্যানবিদ ও সাহিত্যিক। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে হলেও, তাঁর জন্ম কুষ্টিয়া (তখনকার নদীয়া) জেলার কুমারখালি থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে। পিতার নাম কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ, যিনি ছিলেন সেটেলমেন্টের আমিন। মায়ের নাম ছিল তাসিরুন্নেসা। শৈশবকাল কাটান তিনি পাংশার বাগমারায়।
শিক্ষাজীবন
কাজী মোতাহার হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুষ্টিয়া থেকে। ১৯০৭ সালে নিম্ন প্রাইমারি পাশ করার পর ১৯০৯ সালে উচ্চ প্রাইমারি পাশ করেন। ১৯১৫ সালে কুষ্টিয়া মুসলিম হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানেই তিনি প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতো গুণী শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯১৭ সালে রাজশাহী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম জোনে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে এমএ পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পি.এইচ.ডি করেন, যার গবেষণার বিষয় ছিল ‘Design of Experiments’। তার ডক্টরাল থিসিসে তিনি ‘Hussain’s Chain Rule’ নামে একটি নতুন তত্ত্ব প্রবর্তন করেন। পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ) তিনিই প্রথম স্বীকৃত পরিসংখ্যানবিদ।
কর্মজীবন
১৯২১ সালে ঢাকা কলেজে ছাত্র থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রদর্শক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ১৯২৩ সালে সহকারী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে এম.এ. কোর্স চালু করেন এবং এই নতুন বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি গণিত বিভাগেও শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালে পরিসংখ্যানে রিডার হিসেবে পদোন্নতি পান এবং ১৯৫৪ সালে অধ্যাপক হন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন, তবে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিভাগে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে স্থাপিত পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তিনি প্রথম পরিচালক ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
ভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলনে কাজী মোতাহার হোসেনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনার প্রতি বিশ্বাসী তিনি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫০ ও ১৯৬০ দশকে পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষা চালুর দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের তিনি ছিলেন একজন দৃঢ় পৃষ্ঠপোষক। বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রবন্ধ প্রকাশ করে আন্দোলনকে গতিদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ৬-দফা আন্দোলনেরও তিনি একজন বলিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশত বার্ষিকী পালনের সময় প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতার মুখে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের পদক্ষেপের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানান।
তিনি বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার কমিটির সদস্য ছিলেন এবং ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী আয়োজিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে কাজী নজরুল ইসলামের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন এবং নজরুল তার মোতাহার নামকে আদর করে ‘মোতিহার’ ডাকতেন।
রচনাসমগ্র
কাজী মোতাহার হোসেনের সাহিত্যিক অবদান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ১৯২৬ সালে কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল ফজলের সাথে “মুসলিম সাহিত্য সমাজ” গড়ে তোলেন এবং এই সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু সময় ‘শিখা’ নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
- সঞ্চয়ন (১৯৩৭): প্রবন্ধ সংকলন
- নজরুল কাব্য পরিচিতি (১৯৫৫)
- সেই পথ লক্ষ্য করে (১৯৫৮)
- সিম্পোজিয়াম (১৯৬৫)
- গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০)
- আলোক বিজ্ঞান (১৯৭৪)
- নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৭৬)
- প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (অনুবাদ-১৯৬৫)
সম্মাননা
কাজী মোতাহার হোসেনের কৃতিত্ব স্বীকৃত হয়েছে বহু সম্মাননার মাধ্যমে। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৬ সালে প্রবন্ধসাহিত্যের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৭৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ডি.এস.সি ডিগ্রি দ্বারা সম্মানিত করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনের নতুন নামকরণ করা হয় কাজী মোতাহার হোসেন ভবন হিসেবে।
দাবা
১৯২৫ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজনের বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯২৯ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানে একক দাবা চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দাবা খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃত করা হয়। বাংলাদেশে দাবা খেলার পথিকৃৎ হিসেবে তাকে সম্মানিত করা হয় এবং বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের উদ্যোগে কাজী মোতাহার হোসেন স্মৃতি আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতা নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
মৃত্যু
কাজী মোতাহার হোসেন ৯ অক্টোবর, ১৯৮১ তারিখে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অবদান ও স্মৃতিচিহ্ন আজও বাংলাদেশে উজ্জ্বল হয়ে আছে।