আবদুল মান্নান সৈয়দ (জন্মসূত্রে নাম: সৈয়দ আবদুল মান্নান) (৩ আগস্ট ১৯৪৩ – ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০) বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবে সুপরিচিত। তার সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্য এবং গভীরতা বাংলা সাহিত্যকে নতুন দিগন্তের দিকে পরিচালিত করেছে। সাহিত্য জগতে তার অবদান অপরিসীম। তিনি নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের “পোয়েট ইন রেসিডেন্স” ছিলেন। ২০ শতকের ষাটের দশক থেকে তার গবেষণাধর্মী সাহিত্যকর্ম বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়েছে।
জন্ম, শিক্ষা ও জীবিকা
আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্ম অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের পশ্চিমবঙ্গের জালালপুর গ্রামে ১৯৪৩ সালের ৩ আগস্ট। সে সময় ছিল দুর্ভিক্ষের কাল, যা তার শৈশব জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর তার পিতা সৈয়দ এ. এম. বদরুদ্দোজা পরিবারসহ পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসেন এবং ঢাকার গোপীবাগে বসবাস করতে শুরু করেন। তার মাতা কাজী আনোয়ারা মজিদ এবং পরিবারে মোট দশজন সদস্য ছিল। তার স্ত্রী সায়রা সৈয়দ রানু এবং একমাত্র কন্যার নাম জিনান সৈয়দ শম্পা।
তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করে ১৯৬৩ সালে স্নাতক এবং ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা জীবনের শুরুতে তার বাবা তার লেখা প্রকাশে বাধা দেন, কিন্তু তার সাহিত্য চর্চার প্রতি অনুরাগ তাকে কাব্যজীবনে প্রবেশ করতে উৎসাহিত করে। তিনি ১৯৬৫ সালকে তার আত্মপ্রকাশের বছর হিসেবে গণ্য করেছেন।
শিক্ষা জীবনের পরে, তিনি একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে সিলেটে মুরারীচাঁদ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এছাড়াও, তিনি শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ, সিলেটের এম. সি. কলেজে এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।
সাহিত্যচর্চা ও কাব্যশৈলী
আবদুল মান্নান সৈয়দকে বাংলা সাহিত্যের “সব্যসাচী লেখক” হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি ষাটের দশকে বাংলা কবিতার মধ্যে নতুনত্ব এবং আধুনিকতা আনতে সক্ষম হন। তার কাব্যশৈলীতে পরাবাস্তববাদ ও স্যুররিয়ালিজমের প্রভাব লক্ষণীয়। তার প্রথম কবিতা “সোনার হরিণ” ইত্তেফাক পত্রিকায় ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ” ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়, যা বাংলা কবিতায় তার অনন্য অবস্থান প্রতিষ্ঠা করে।
আবদুল মান্নান সৈয়দের কাব্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য হলো আধুনিকতা ও নন্দনতত্ত্বের বহুমাত্রিক প্রয়োগ। তার কবিতায় পরাবাস্তববাদী চিত্রকল্প ও ভাষার অভিনব ব্যবহারের জন্য তিনি পরিচিত। তিনি শৈল্পিক দিক থেকে বাংলা কবিতায় নতুন একটি দিগন্ত খুলে দিয়েছেন। তার কবিতা সাধারণত প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়, যা বাংলা কবিতায় একটি নতুন বৈভব নিয়ে আসে।
১৯৮০-এর দশকে তার সবচেয়ে ফলপ্রসূ সময় ছিল। এই সময়ে তার ৬টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যা শৈলী ও বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে ভাস্বর। তার কবিতার নির্বাচিত সংকলন “নির্বাচিত কবিতা” (২০০১) তার কবিসত্তার সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরে।
সাহিত্য-সমালোচনা
আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্য-সমালোচক হিসেবেও পরিচিত। তার সমালোচনার ক্ষেত্রটি নিবিড় গবেষণার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। তিনি সাহিত্য সমালোচনার জন্য একটি নিজস্ব ভাষা তৈরি করেছেন যা দুর্জ্ঞেয় হলেও প্রকাশক্ষমতায় ঋদ্ধ। তার প্রবন্ধগুলোর মধ্যে “শুদ্ধতম কবি”, “করতলে মহাদেশ”, এবং “দশ দিগণ্তের দ্রষ্টা” উল্লেখযোগ্য। তার সমালোচনায় সৃজনশীলতা এবং নন্দনতত্ত্বের মিশ্রণ বিদ্যমান, যা তাকে ষাটের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে স্বতন্ত্র করে তোলে।
জীবনানন্দ দাশ ও নজরুল চর্চা
আবদুল মান্নান সৈয়দ আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ জীবনানন্দ দাশের ওপর বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন। তার “শুদ্ধতম কবি” গ্রন্থে জীবনানন্দ দাশের কবিতা, গল্প ও পত্রাবলী সংগ্রহ করেছেন, যা জীবনানন্দ চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
নজরুল চর্চার ক্ষেত্রেও তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি কবি মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ এবং প্রাবন্ধিক শাহাবুদ্দীন আহমদের গবেষণা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তার “নজরুল ইসলাম – কবি ও কবিতা” গ্রন্থটি নজরুল চর্চার একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ।
কথাসাহিত্য ও নাটক
আবদুল মান্নান সৈয়দ কথাসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো “সত্যের মত বদমাশ”, “চলো যাই পরোক্ষে”, এবং “মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা”। “সত্যের মত বদমাশ” অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছিল। তার গল্প ও উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রাধ্যন্য পেয়েছে।
নাটকেও তিনি অবদান রেখেছেন। তার নাটকগুলোর মধ্যে “বিশ্বাসের তরু”, “জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা”, এবং “ঈশ্বরপ্রাপ্তির ছোট্ট গাঁথা” উল্লেখযোগ্য। ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমী তার নাট্যগুচ্ছ প্রকাশ করে এবং ২০০৯ সালে নাট্যসমগ্র প্রকাশিত হয়।
সম্পাদনা ও চিত্রকলা
সম্পাদনায় আবদুল মান্নান সৈয়দ অতুলনীয় ধৈর্য ও পরিশ্রমের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা, ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা, এবং বাংলাদেশের কবিতা ইত্যাদি সংকলন করেছেন।
ছোটবেলা থেকেই চিত্রকলায় আগ্রহী ছিলেন। ষাটের দশকে বেশ কিছু ছবি আঁকেন, যদিও দীর্ঘকাল তার আঁকিয়ে পরিচয়টি লুপ্ত ছিল। ২০০৮ সালে তার আঁকা ছবি পুনরায় প্রকাশিত হলে এটি আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।
মৃত্যু ও চারিত্র্য
আবদুল মান্নান সৈয়দ দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। ২০১০ সালের ২৭ আগস্ট চ্যানেল আইয়ে এক আলোচনায় অংশগ্রহণকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ৫ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুর পর বাংলা সাহিত্য এক অপূরণীয় শূন্যতায় নিমজ্জিত হয়েছে।
তার চরিত্র ছিল গভীর অভিমানী এবং কৌতুকপ্রিয়। তার সৃষ্টিশীলতা এবং সাহিত্যকর্মের প্রতি তার নিবেদিত প্রাণতা তাকে বাংলা সাহিত্যজগতে একটি বিশেষ স্থান এনে দিয়েছে।
প্রকাশিত গ্রন্থাবলি
কবিতা:
- জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭)
- জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা (১৯৬৯)
- ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ (১৯৭৪)
- কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৮২)
- পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮৪)
- পার্ক স্ট্রিটে এক রাত্রি (১৯৮৩)
- মাছ সিরিজ (১৯৮৪)
- সকল প্রশংসা তার (১৯৯৩)
- নির্বাচিত কবিতা (২০০১)
উপন্যাস:
- পরিপ্রেক্ষিতের দাস-দাসী
- অ-তে অজগর (১৯৮২)
- কলকাতা (১৯৮০)
- ক্ষুধা প্রেম আগুন (১৯৯৪)
ছোটগল্প:
- সত্যের মতো বদমাশ
- চলো যাই পরোক্ষে (১৯৭৩)
- মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা
নাটক:
- বিশ্বাসের তরু
- জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা
- ঈশ্বরপ্রাপ্তির ছোট্ট গাঁথা
আবদুল মান্নান সৈয়দের সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় যোগ করেছে। তার কাব্যিক ভাষা, সাহিত্য সমালোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। তার সাহিত্য ও শিল্পের প্রতি অমোঘ প্রেম বাংলা সাহিত্যকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে।