Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

আবদুল গাফফার চৌধুরী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

আবদুল গাফফার চৌধুরী (১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪ — ১৯ মে ২০২২) ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। তাঁর উল্লেখযোগ্য কর্মের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” অন্যতম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে প্রকাশিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা “সাপ্তাহিক জয়বাংলা”র প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হিসেবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর অমর অবদান স্বীকৃত হয়েছে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পুরস্কার সহ বহু সম্মানে।

জন্ম ও বংশ

আবদুল গাফফার চৌধুরী ১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাকেরগঞ্জ জেলার মেহেন্দিগঞ্জ মহকুমার উলানিয়া জমিদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার উলানিয়া চৌধুরী বংশ নামে পরিচিত, যা বাংলার ঐতিহ্যবাহী মুসলমান পরিবার। তাঁর পূর্বপুরুষ শায়খ মহম্মদ আসাদ আলী পারস্য থেকে ভারতে আসেন এবং মুর্শিদাবাদে বসবাস শুরু করেন। শায়খ মহম্মদ আসাদ আলীর পরবর্তী প্রজন্ম মগ-পর্তুগিজ জলদস্যু দমনে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীতে এই পরিবার উলানিয়ায় বসতি স্থাপন করে।

তাঁর বাবা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী এবং মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন ছিলেন। পরিবারের মধ্যে তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী এবং ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী ছিলেন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব, এবং তাঁর পাঁচ বোন হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম এবং মাসুমা বেগম।

শিক্ষাজীবন

আবদুল গাফফার চৌধুরীর শিক্ষা জীবন ছিল সংগ্রামপূর্ণ। তিনি উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৫৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করার পর, তাঁর জীবনের প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনৈতিক অনটন। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে আর্থিক দুরবস্থা দেখা দেয়, যার কারণে তিনি বরিশাল শহরে চলে আসেন এবং আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন।

সাময়িক পত্রিকা “কংগ্রেস হিতৈষী”তে কাজ শুরু করার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিক জীবনের সূচনা হয়। ছাত্রজীবনেই সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল, এবং ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়।

কর্মজীবন

আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৫০ সালে “দৈনিক ইনসাফ” পত্রিকায়। পরবর্তীতে, তিনি “দৈনিক সংবাদ” এবং “মাসিক সওগাত” পত্রিকায় অনুবাদকের কাজ করেন। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের “মাসিক সওগাত” পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন এবং একই বছরে “মাসিক নকীব” ও “দিলরুবা” পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।

১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা “মেঘনা”র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৫৮ সালে “চাবুক” নামের একটি রাজনৈতিক পত্রিকার সম্পাদক হন, কিন্তু সামরিক শাসনের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর, মওলানা আকরম খাঁর “দৈনিক আজাদ”-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন এবং “মোহাম্মদীর” পত্রিকারও সম্পাদনা করেন। ১৯৬২ সালে দৈনিক “জেহাদ” এ বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৬৩ সালে সাপ্তাহিক “সোনার বাংলা”র সম্পাদক হন। ১৯৬৪ সালে ব্যবসায় নামলেও কিছুদিন পর সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন।

১৯৬৭ সালে “দৈনিক আওয়াজ” নামের একটি পত্রিকা বের করেন, যা বছর দুয়েক চলেছিল। ১৯৬৯ সালে “দৈনিক ইত্তেফাক”ে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে “পূর্বদেশ” পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানকার “সাপ্তাহিক জয়বাংলা” পত্রিকায় লেখালেখি করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে “দৈনিক জনপদ” বের করেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। দেশে ফেরার পর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে কলকাতা ও পরে লন্ডনে চলে যান। লন্ডনে বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেন এবং ১৯৭৬ সালে “বাংলার ডাক” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। প্রবাসে থেকে তিনি বাংলাদেশি প্রধান পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত কলাম লিখে গেছেন।

সাহিত্যকর্ম

আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম তার রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনাকে প্রতিফলিত করে। তাঁর গ্রন্থগুলির মধ্যে “ডানপিটে শওকত” (১৯৫৩), “কৃষ্ণপক্ষ” (১৯৫৯), “চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান” (১৯৬০), “নীল যমুনা” (১৯৬৪) এবং “শেষ রজনীর চাঁদ” (১৯৬৭) উল্লেখযোগ্য। তাঁর “আমরা বাংলাদেশী নাকি বাঙ্গালী” (১৯৯৩) গ্রন্থটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।

তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস “ইতিহাসের রক্ত পলাশ” এবং চলচ্চিত্র সম্পর্কিত বই “পলাশী থেকে ধানমণ্ডি” (২০০৭) সাহিত্যজগতে বিশেষ স্থান অধিকার করেছে।

পুরস্কার ও সম্মাননা

আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম ও সাংবাদিকতার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বহু পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে একুশে পদক, ২০০৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, এবং ২০০৯ সালে সংহতি আজীবন সম্মাননা পদক সহ বহু সম্মানে ভূষিত হন। এছাড়াও, যুক্তরাজ্যের টাওয়ার হ্যামলেটসে ফ্রিডম অব বারা উপাধি পান।

জীবনাবসান

আবদুল গাফফার চৌধুরী ২০২২ সালের ১৯ মে লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তাঁর মরদেহ দেশে আনা হয় ২১ মে এবং কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। পরে, ঢাকার মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্ত্রীর পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাহিত্য ও সাংবাদিকতা জীবনের মাধ্যমে বাংলাদেশি সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ও লেখা, বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো”, আজও বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

প্রমথ চৌধুরী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান

Read More
সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান ও অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। গবেষণার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা এবং মানুষের

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.