আবদুল কাদির (১ জুন ১৯০৬ – ডিসেম্বর ১৯৮৪) বাংলা সাহিত্য জগতের এক অনন্য মুখ। কবি, সাহিত্য-সমালোচক ও ছান্দসিক হিসেবে তিনি স্বতন্ত্র পরিচিতি লাভ করেন। তার জীবন ও সাহিত্যকর্মে যেমন রয়েছে বাংলা সাহিত্যের নানা দিকের সূক্ষ্ম পর্যালোচনা, তেমনি বাংলা ভাষার ছন্দের ঐতিহ্যবাহী ধারা তাঁর লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা আবদুল কাদিরের জীবনের বিভিন্ন দিক এবং তার সাহিত্যকর্মের গভীর বিশ্লেষণ করব।
জীবনের সূচনা
আবদুল কাদির ১৯০৬ সালের ১ জুন বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত শৈশবে তিনি মাতৃহারা হন, যা তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দুঃখজনক অধ্যায়। শৈশবেই পরিবারের অভাব এবং শূন্যতার মুখোমুখি হয়ে, তাঁর জীবনে প্রচন্ড অধ্যবসায় ও আত্মনির্ভরতার চিহ্ন অঙ্কিত হয়।
তিনি ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাঁচটি বিষয়ে লেটারসহ ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯২৫ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ. পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। শিক্ষাজীবনের এই সাফল্য তার ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের ভিত্তি তৈরি করে।
সাংবাদিক জীবন
১৯২৬ সালে আবদুল কাদির কলকাতার বিখ্যাত সওগাত পত্রিকায় সম্পাদনা বিভাগে চাকরি গ্রহণ করেন। তাঁর সাংবাদিক জীবনের শুরু এখান থেকেই। ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতা করপোরেশনের একটি প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, যা তার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি উৎসাহ প্রকাশ করে।
১৯৩৫ সালে কমরেড মুজাফফর আহমদের কন্যা আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন এবং তাদের সংসার জীবন সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ হয়। বাংলা ১৩৩৭ সালে তিনি জয়তী নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন এবং একই বছরে নবশক্তি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৩৮ সালে কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় যোগ দেওয়ার মাধ্যমে সাংবাদিক জীবনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে, আবদুল কাদির সরকারের প্রচার সংস্থার বাংলা অনুবাদক পদে যোগ দেন এবং ১৯৪৬ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও অর্ধ-সাপ্তাহিক পয়গাম পত্রিকায় কর্মরত হন।
পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপত্র মাসিক বিখ্যাত মাহেনও পত্রিকায় কর্মরত থাকার পর ১৯৬৪ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশনা কর্মকতার পদে নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৭০ সালের ১ জুন সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সাহিত্যকর্ম
আবদুল কাদিরের সাহিত্যকর্ম তার সময়ের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি। তিনি মোহিতলাল মজুমদারের ধ্রুপদী সংগঠন এবং নজরুলের উদাত্ত আবেগের চমৎকার সমন্বয় ঘটান। মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতৃত্বে ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন সূচিত হয়, এবং কবি আবদুল কাদির তার প্রধান উদ্যোক্তা। সাহিত্য সমাজের মুখপত্র বার্ষিক শিখা (১৯২৭) পত্রিকার প্রকাশক ও লেখক হিসেবে তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ
আবদুল কাদিরের কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম ‘দিলরুবা’ (১৯৩৩) এবং ‘উত্তর বসন্ত’ (১৯৬৭)। ‘দিলরুবা’ কাব্যগ্রন্থে তাঁর কবিতার ছন্দ এবং ভাবের গভীরতা প্রতিফলিত হয়েছে। ‘উত্তর বসন্ত’ গ্রন্থে তিনি বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারা এবং কাব্যিক বৈশিষ্ট্যের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরেছেন।
‘ছন্দ সমীক্ষণ’ (১৯৭৯) গ্রন্থে আবদুল কাদির বাংলা ছন্দ সম্পর্কে মৌলিক বক্তব্য প্রদান করেছেন, যা বাংলা ছন্দের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণারূপে গণ্য। তাঁর সাহিত্য সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ‘কাব্য মালঞ্চ’, ‘মুসলিম সাহিত্যের সেরা গল্প’, ‘নজরুল রচনাবলি’, ‘রোকেয়া রচনাবলি’, ‘শিরাজী রচনাবলি’, ‘লুৎফর রহমান রচনাবলি’, ‘ইয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলি’, ‘আবুল হুসেন রচনাবলি’, ‘কাব্যবীথি’ প্রভৃতি গ্রন্থে তার সম্পাদনার দক্ষতা প্রমাণিত।
সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতি
আবদুল কাদিরের সাহিত্যকীর্তি স্বীকৃত হয়েছে নানা পুরস্কারে। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, মুক্তধারা পুরস্কার সহ অন্যান্য সম্মাননা লাভ করেন। এই পুরস্কারগুলো তার সাহিত্যকর্মের গভীরতা এবং গুণমানের প্রমাণ।
আবদুল কাদিরের জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্য জগতে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তার কবিতা, সাহিত্য-সমালোচনা, এবং ছন্দের গবেষণা বাংলা সাহিত্যকে নতুন দিগন্ত দেখিয়েছে। তার লেখনী ও সম্পাদনা বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্যের রক্ষক হিসেবে বিবেচিত হয়। আবদুল কাদিরের জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।