সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১) একজন প্রখ্যাত বাঙালি লেখক ও কবি। ১৮৮০ সালের ১৩ই জুলাই, ব্রিটিশ ভারতের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী শাহ সৈয়দ আবদুল করিম খন্দকার, একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর এবং ইউনানি চিকিৎসক। মায়ের নাম নূর জাহান খানম, যিনি পশতুন বংশোদ্ভূত। সিরাজীর পরিবারের আরব বংশের পরিচয় তার নামের আগে ‘সৈয়দ’ উপাধি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। সিরাজীর পূর্বপুরুষেরা বাংলায় আসার পর মুঘল দরবারে চাকরি লাভ করেন এবং ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে পরিচিত হন।
শৈশবে তিনি স্থানীয় পাঠশালা ও জ্ঞানদায়িনী মাইনর ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর সিরাজগঞ্জ বনোয়ারীলাল হাই স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। সিরাজী পাঠশালায় ফার্সি এবং বাড়িতে সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন এবং সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্যের সাথে হিন্দুশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।
কর্মজীবন
ইসমাইল হোসেন সিরাজী বক্তা হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি বাঙালি মুসলিম পুনর্জাগরণ ও রাজনৈতিক বিষয়ে বক্তৃতা করতেন। তার বক্তৃতা ও লেখার মাধ্যমে তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও সমাজ সংস্কারের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম সাম্যের পক্ষে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমিতিতে সক্রিয় ছিলেন, যেমন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, স্বরাজ পার্টি, কৃষক সমিতি ইত্যাদি।
ছাত্রাবস্থায়ই সিরাজী কবিতা লিখতে শুরু করেন। ধর্মবক্তা মুনশী মেহের উল্লাহর এক জনসভায় তার কাব্যগ্রন্থ ‘অনল-প্রবাহ’ পাঠ করেন। মুনশী মেহের উল্লাহ কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে নিজের ব্যয়ে ১৯০০ সালে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেন। কিন্তু ১৯০৮ সালের শেষ দিকে বইটির বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং তৎকালীন বাংলা সরকার এটি বাজেয়াপ্ত করে। এর পর সিরাজী ফরাসী-অধিকৃত চন্দননগরে গিয়ে ৮ মাস আত্মগোপন করেন এবং পরে আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের অভিযোগে তাকে দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
সাহিত্য কর্ম
ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সাহিত্য কর্মে তার রাজনৈতিক আদর্শ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম দিকের মুসলমান লেখকদের মধ্যে অন্যতম। তার রচনাসমূহ ইসলামি সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও কবি আবদুল কাদির মন্তব্য করেন যে, বঙ্কিমচন্দ্রের “উগ্র জাতীয়তাবাদ” মুসলমানদের মধ্যে সিরাজীর রচনাতে প্রথম দেখা যায়। সিরাজীর রচনাবলী সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, বিশেষত তার কাব্যগ্রন্থ ও উপন্যাস।
কাব্যগ্রন্থ
- অনল-প্রবাহ (১৯০০): সিরাজীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যা তার সাহিত্যজীবনের শুরু।
- আকাঙ্ক্ষা (১৯০৬): পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ যা তার কবিতার গভীরতা এবং সামাজিক চিন্তার প্রতিফলন।
- উছ্বাস (১৯০৭): সিরাজীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ।
- উদ্বোধন (১৯০৭): সিরাজীর সাহিত্যের অগ্রগতির একটি চিহ্ন।
- নব উদ্দীপনা (১৯০৭): তার সাহিত্যিক অভিব্যক্তির নতুন ধারা।
- স্পেন বিজয় কাব্য (১৯১৪): স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতার সৃজনশীল চিত্র।
- মহাশিক্ষা মহাকাব্য (১ম খণ্ড-১৯৬৯, ২য় খণ্ড-১৯৭১): একটি বিশাল সাহিত্যমূলক রচনা যা তার সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা।
উপন্যাস
- রায়নন্দিনী (১৯১৫): একটি সামাজিক উপন্যাস যা তার সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্য প্রকাশ করে।
- তারাবাঈ (১৯১৬): সিরাজীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস।
- ফিরোজা বেগম (১৯১৮): মুসলমান নারীর চরিত্রের বিশ্লেষণ।
- নূরউদ্দীন (১৯১৯): মুসলিম সমাজের একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস।
- জাহানারা (১৯৩১): তার সাহিত্যজীবনের শেষ উপন্যাস।
- বঙ্গ ও বিহার বিজয় (১৮৯৯, অসমাপ্ত): অসমাপ্ত উপন্যাস যা তার সাহিত্যের বৈচিত্র্যকে প্রদর্শন করে।
- বঙ্কিম দুহিতা: একটি প্রভাবশালী উপন্যাস।
সঙ্গীত গ্রন্থ
- সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬): সঙ্গীত সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
- প্রেমাঞ্জলি (১৯১৬): প্রেমের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
প্রবন্ধ
- স্ত্রীশিক্ষা: নারী শিক্ষা সম্পর্কে সিরাজীর দৃষ্টিভঙ্গি।
- স্বজাতি প্রেম (১৯০৯): জাতীয় প্রেম এবং সংহতির বিষয়ে প্রবন্ধ।
- আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪): সমাজে আদব কায়দার গুরুত্ব সম্পর্কে প্রবন্ধ।
- স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা (১৯১৬): স্পেনীয় মুসলমানদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতি নিয়ে প্রবন্ধ।
- সুচিন্তা (১৯১৬): চিন্তাশীলতার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা।
- মহানগরী কর্ডোভা: একটি শহর বিশ্লেষণ যা তার লেখার বৈচিত্র্য প্রদর্শন করে।
- আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা: আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব সম্পর্কে প্রবন্ধ।
- তুর্কী নারী জীবন (১৯১৩): তুর্কী নারীদের জীবন এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে প্রবন্ধ।
ভ্রমণ কাহিনী
- তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১০): তুরস্ক সফরের একটি বিস্তৃত বিবরণ যা তার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক অবদান
ইসমাইল হোসেন সিরাজী মুসলিম পুনর্জাগরণ আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য নানা ধরনের লেখালেখি ও বক্তৃতা দেন। তিনি মুসলমানদের মধ্যে বিজ্ঞানসাধনা, মাতৃভাষাচর্চা এবং নারীদের শিক্ষা প্রসারের পক্ষে ছিলেন। তার রাজনৈতিক চিন্তা ও সাহিত্য সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে। সিরাজীর চিন্তা-চেতনা ও কাজগুলি বাঙালি মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সিরাজীর জীবনে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতার কারণে ৮২ বার তার বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং তিনি ১৯১০ সালে কারাবন্দী হন। তার সাহিত্যের গভীরতা এবং সামাজ উন্নয়নের প্রতি তার অবদান তাকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম করে রেখেছে।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তার কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং ভ্রমণ কাহিনী বাংলা সাহিত্যকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। তার সাহিত্যে মুসলিম সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পুনর্জাগরণের প্রভাব স্পষ্ট। সিরাজীর সাহিত্য কর্ম ও সমাজসেবা তাকে একটি অনন্য স্থান প্রদান করেছে বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি প্রেরণা হিসেবে থাকবে।