রাজা রামমোহন রায় (২২ মে ১৭৭২ – ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩) ভারতীয় সমাজের এক মহান সংস্কারক এবং দার্শনিক, যিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। তাঁর জীবন এবং কর্মের মাধ্যমে তিনি শুধু ভারতীয় সংস্কারের পথিকৃৎই ছিলেন না, বরং আধুনিক ভারতের ভিত্তি রচনা করেছিলেন।
শৈশব ও শিক্ষা
রাজা রামমোহন রায় হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রামকান্ত ছিলেন একজন বৈষ্ণব এবং মা ফুলঠাকুরানী দেবী শৈব ধর্মের অনুসারী। রামমোহন খুব অল্প বয়সেই শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরেজি, আরবি, ল্যাটিন এবং গ্রীক ভাষা শিখে একটি উজ্জ্বল পণ্ডিত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
তরুণ বয়সে রামমোহন বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে জ্ঞানলাভের চেষ্টা করেন এবং কাশী ও পাটনায় কিছু সময় কাটান। নেপালে গিয়ে তিনি তন্ত্রশাস্ত্রবিদ নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের সাথে পরিচিত হন, যিনি পরবর্তীতে তাঁর বেদান্তে অনুরাগের সৃষ্টি করেন।
কর্মজীবন
১৮০৩ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে কাজ করার পর, ১৮১৫ সালে রামমোহন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এখানেই তাঁর সংস্কারমূলক কাজের শুরু হয়। তিনি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ “তুহফাতুল মুহাহহিদিন” (১৮১৫) তে একেশ্বরবাদের সমর্থন করেন এবং পরবর্তীতে বাংলায় বেদান্ত-সূত্র এবং উপনিষদগুলি অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন।
সামাজিক সংস্কার
রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কারের কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করেন এবং এটি নিষিদ্ধ করার জন্য আইন প্রণয়ন করেন। এছাড়াও, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ এবং বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। নারীদের জন্য সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা, এবং একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি ব্রাহ্মসমাজ গঠন করেন।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান
শিক্ষার ক্ষেত্রে রামমোহনের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ১৮১৭ সালে ডেভিড হেয়ারের সহযোগিতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮২২ সালে অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল এবং ১৮৩০ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। তিনি ভারতীয় শিক্ষা পদ্ধতিতে পাশ্চাত্য শিক্ষার সংমিশ্রণ সমর্থন করেন।
সাহিত্যকর্ম
রাজা রামমোহন রায়ের সাহিত্যকর্মের মধ্যে বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫), বেদান্ত সার (১৮১৫), এবং উপনিষদ গ্রন্থাবলি উল্লেখযোগ্য। তিনি পাঁচটি উপনিষদের বাংলা অনুবাদ করেন, যার মধ্যে কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডুক্যোপনিষদ এবং মুণ্ডকোপনিষদ অন্তর্ভুক্ত। তাঁর “সংবাদ কৌমুদী” পত্রিকা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং ভারতীয়দের চাকরির উচ্চ পদে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে নানা বিষয় তুলে ধরেছিল।
শেষ জীবন ও উত্তরাধিকার
১৮৩০ সালে রামমোহন বিলেত যাত্রা করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাঁর দাবিগুলি উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি ফরাসি সম্রাট লুই ফিলিপ দ্বারা সম্মানিত হন। ১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডে মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমাধিস্থলে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৯৭ সালে ব্রিস্টলে একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
রাজা রামমোহন রায়ের অবদান শুধুমাত্র তাঁর সমকালীন সমাজেই নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর সংস্কারমূলক কাজ, সাহিত্যকর্ম এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান তাঁকে একটি অমর চরিত্রে পরিণত করেছে।