আবুল ফজল (১ জুলাই ১৯০৩—৪ মে ১৯৮৩) ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রখ্যাত সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার ও সমাজচিন্তক। তার সাহিত্যকর্মে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি ও মানবতন্ত্রের ওপর তার গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অসামান্য এবং তিনি একজন মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাষ্ট্রপতির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
আবুল ফজল ১৯০৩ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়ায় এক সমৃদ্ধ ও সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলবি ফজলুর রহমান এবং মাতা গুলশান আরা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ফজল ছোটবেলা থেকেই প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়, যেখানে তিনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে তার শৈশব অতিবাহিত করেন। পরবর্তীতে বাবার সাথে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন এবং নন্দন কাননের একটি স্কুলে ভর্তি হন।
এরপর ১৯১৩/১৪ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯২৫ সালে ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান নাম – কবি নজরুল সরকারি কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে বিএ পাস করেন এবং ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন
আবুল ফজলের পিতা চেয়েছিলেন যে, তিনি একজন আলেম হবেন, কিন্তু সাহিত্য তাকে বেশি আকর্ষণ করেছিল। ফলে তিনি শিক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২৯ সালে তিনি বিটি পড়ার জন্য ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৩১ সালে বিটি পাস করে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে দ্বিতীয় মৌলবি হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। কিছুদিন পর তিনি সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর কাজেম আলী বেসরকারি হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৩ সালে খুলনা জেলা স্কুলে দ্বিতীয় পণ্ডিতের পদে স্থায়ীভাবে যোগ দেন এবং ১৯৩৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে সহকারী ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৪১ সালে তিনি কৃষ্ণনগর কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৯ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরেও তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
সাহিত্যকর্ম
আবুল ফজল মূলত একজন প্রবন্ধকার হলেও তার সাহিত্যকর্মে বিভিন্ন ধরনের রচনা পাওয়া যায়। তার রচনায় সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে রয়েছে:
- জীবনপথের যাত্রী: আবুল ফজলের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, যেখানে তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, অভিজ্ঞতা এবং জীবনদর্শন বর্ণিত হয়েছে।
- রাঙ্গা প্রভাত (১৯৬৪): এটি একটি উপন্যাস যা সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবজীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে।
- চৌচির (১৯৩৪): এই উপন্যাসটি সমাজের বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ।
- মাটির পৃথিবী (১৩৪৭): এটি একটি গল্পগ্রন্থ যা সমাজের প্রান্তিক মানুষদের জীবন নিয়ে লেখা।
- মৃতের আত্মহত্যা: এই গল্পগ্রন্থে মানবজীবনের অসারতা ও অস্তিত্বের সংকট নিয়ে লেখা।
- আয়েশা: এটি তার একটি বিখ্যাত গল্প যা সমাজের নিপীড়িত নারীদের জীবন নিয়ে লেখা।
- আবুল ফজলের শ্রেষ্ঠ গল্প: এই সংকলনে তার শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো স্থান পেয়েছে।
- সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন: এই গ্রন্থে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনের ওপর তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে।
- সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র: এই গ্রন্থে সমাজ, সাহিত্য এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনা বর্ণিত হয়েছে।
- মানবতন্ত্র (১৯৭২): মানবজীবনের মূ্ল্যবোধ ও মানবতার চর্চা নিয়ে লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ।
- শুভবুদ্ধি (১৯৭৪): এই গ্রন্থে শুভবুদ্ধির চর্চা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখা।
- সমকালীন চিন্তা: বর্তমান সময়ের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে তার চিন্তাভাবনা বর্ণিত হয়েছে।
- রেখাচিত্র: এটি তার দিনলিপি, যেখানে তিনি তার দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা ও ভাবনা তুলে ধরেছেন।
- সফরনামা: এই গ্রন্থে তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে।
- দুর্দিনের দিনলিপি: এটি একটি দিনলিপি যেখানে তিনি তার জীবনের দুঃসময়গুলোর কথা লিখেছেন।
- প্রদীপ ও পতঙ্গ (১৯৪৭): এই গ্রন্থে তিনি সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
আবুল ফজলের সাহিত্যকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে। ২০১২ সালে তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট প্রাইড অফ পারফরম্যান্স সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮০ সালে নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, ১৯৮১ সালে মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮২ সালে আব্দুল হাই সাহিত্য পদক এবং রাষ্ট্রীয় সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননা লাভ করেন।
মৃত্যুবরণ
আবুল ফজল ১৯৮৩ সালের ৪ মে চট্টগ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে একটি বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তার চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, এবং সাহিত্যকর্ম আজও পাঠক সমাজের মনে গভীর প্রভাব ফেলছে এবং তাকে স্মরণ করা হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রবাদপুরুষ হিসেবে।
আবুল ফজলের জীবন ও সাহিত্যকর্ম থেকে বোঝা যায় যে, তিনি একজন সত্যিকারের মানবতাবাদী ছিলেন। তার রচনায় সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, মুক্ত চিন্তা, এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।