জন্ম ও পরিবার আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী (২৭ নভেম্বর ১৯২৫ – ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, এবং বুদ্ধিজীবী। তিনি ঢাকার মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন গোপাইরবাগ গ্রামে। তিনি ইংরেজ আমলের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন। তাঁর অগ্রজ কবীর চৌধুরী এবং অনুজা ফেরদৌসী মজুমদার।
শিক্ষা ও ছাত্রজীবন মুনীর চৌধুরী ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন এবং ১৯৪৩ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স (১৯৪৬) ও মাস্টার্স (১৯৪৭) সম্পন্ন করেন। তিনি ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং বক্তৃতায় পারদর্শিতার জন্য প্রোভোস্ট্স কাপ জিতেন। বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণে তাকে সলিমুল্লাহ হল থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং পিতার আর্থিক সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হন। এই সময় তিনি ঢাকা বেতার কেন্দ্রের জন্য নাটক লিখে আয় করেন। ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বক্তৃতা করেন।
কমিউনিস্ট পার্টি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর, মুনীর চৌধুরী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির অধীনে পূর্ববঙ্গে একটি আঞ্চলিক কমিটিতে যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালের মার্চে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রগতি লেখক সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকারের হাতে বন্দী হন। ১৯৬৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচারে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেন এবং ১৯৬৮ সালে বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
শিক্ষকতা ও গবেষণা ১৯৪৯ সালে ব্রজলাল কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়ে জেলে বন্দী থাকাকালে “কবর” নামক নাটক রচনা করেন। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ১৯৫৬ সালে বাংলার প্রভাষক হিসেবে চাকুরি স্থায়ী করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৬৯ সালে বাংলা বিভাগের প্রধান হন।
বাংলা টাইপরাইটার উন্নয়ন মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে বাংলা টাইপরাইটারের উন্নতমানের কী-বোর্ড উদ্ভাবন করেন, যার নাম “মুনীর অপ্টিমা”। এই কীর্তি বাংলা টাইপিংকে আরও সহজ এবং দ্রুততর করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সাহিত্যকর্ম মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্মে নাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদ নাটক এবং বাংলা টাইপিংয়ের উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকসমূহ:
- কবর (১৯৫৩): ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত প্রতিবাদী নাটক।
- রক্তাক্ত প্রান্তর (১৯৬২): পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের কাহিনী ভিত্তিক নাটক।
- চিঠি (১৯৬৬): একটি নাটক যা তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করে।
- দণ্ডকারণ্য (১৯৬৬): একটি রূপকাশ্রয়ী নাটক।
মৃত্যু ও সম্মাননা ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর মুনীর চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং আল-বদর বাহিনীর হাতে অপহৃত হন এবং সম্ভবত ঐ দিনই নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সাহিত্যকর্ম ও জীবনদর্শন বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবে। মৃত্যুর পর তাঁকে বিভিন্ন সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে:
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২)
- দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫)
- সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৬, মার্চ ১৯৭১ বর্জন করেন)
- স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮০)
মুনীর চৌধুরীর জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।