মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে ১৯০৮ – ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তার প্রকৃত নাম ছিল প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক এবং তার কাজসমূহ বাংলা সাহিত্যকে নতুন দিশা দিয়েছে।
প্রারম্ভিক জীবন
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে, বর্তমান লৌহজং এলাকায়। তার পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতার নাম নীরদাসুন্দরী দেবী। তারা চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে মানিক ছিলেন অষ্টম। পিতার চাকরির বদলির কারণে মানিকের শৈশব ও কৈশোর বিভিন্ন শহরে অতিবাহিত হয়, যেমন—দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবণি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি।
শিক্ষাজীবন
১৯২৬ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ১৯২৮ সালে বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় পাস করেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হলেও লেখালেখিতে আগ্রহ থাকায় তার একাডেমিক পড়াশোনা প্রায় শেষ হয়ে যায়।
সাহিত্য জীবন
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবন শুরু হয় ছোট গল্পের মাধ্যমে। তিনি কলেজ ক্যান্টিনে একটি বাজি ধরে তার লেখা গল্প বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত করবেন। এই বাজির জন্য তিনি তার প্রথম গল্প “অতসী মামী” লিখেন এবং এটি বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়। এই গল্পের সাফল্য তাকে বাংলা সাহিত্যে পরিচিত করে তোলে।
সাহিত্যকর্ম
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম বৈপ্লবিক ছিল এবং তার লেখা সাধারণ মানুষের জীবনের গভীর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে। তিনি ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ এবং মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যা তার রচনায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তার কাজের মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, এবং নিয়তিবাদ।
উপন্যাস
- দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫): এই উপন্যাসটি মধ্যবিত্ত জীবন এবং তার অন্তর্দ্বন্দ্বের ছবি তুলে ধরে।
- পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬): বাংলার গ্রামীণ জীবন এবং মানুষের সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্র।
- পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬): পদ্মা নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনযাত্রার চিত্র তুলে ধরে।
- অমৃতস্য পুত্রাঃ (১৯৩৮): সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা।
- শহরতলি (প্রথম খণ্ড ১৯৪০, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৪১): শহরের উপকণ্ঠের মানুষের জীবনের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরেছে।
- চিন্তামণি (১৯৪৬): সমাজ ও মানব প্রকৃতির জটিলতা নিয়ে লেখা।
- জীয়ন্ত (১৯৫০): জীবনের নানা দিক নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা।
- স্বাধীনতার স্বাদ (১৯৫১): স্বাধীনতার পরবর্তী সমাজের চিত্র।
ছোটগল্প
- অতসী মামীও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫): গল্পগুলো সাধারণ মানুষের জীবনের নানা দিক তুলে ধরে।
- প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭): অতীতকালীন চরিত্র ও ঘটনাসমূহ।
- মিহি ও মোটা কাহিনী (১৯৩৮): মানবিক সম্পর্ক ও বিচিত্র চরিত্র।
- ভেজাল (১৯৪৪): সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে লিখা।
- লাজুকলতা (১৯৫৪): বিভিন্ন চরিত্রের মিশ্রণ।
নাটক
- ভিটেমাটি (১৯৪৬): নাটকটি মধ্যবিত্ত সমাজের জীবনের নানা দিক তুলে ধরে।
মৃত্যু
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫৫ সালের শেষে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬ তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু কেবল বাংলা সাহিত্য নয়, সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যকেই এক অভাবনীয় ক্ষতি প্রদান করে।
তার সাহিত্যকর্ম আজও বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং বিভিন্ন ভাষায় তার কাজ অনূদিত হয়েছে।