বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১২ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ – ১ নভেম্বর ১৯৫০) পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী মুরাতিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিল বারাকপুর গ্রামে, তবে তাদের আদিবাস ছিল বসিরহাট মহকুমার পানিতর গ্রামে। তার পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত এবং পাণ্ডিত্য ও কথকতার জন্য শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। মাতা মৃণালিনী দেবী ছিলেন গৃহিণী এবং তাদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বিভূতিভূষণ ছিলেন বড়ো।
শিক্ষাজীবন
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শুরু হয় পিতার কাছে। এরপর গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন পাঠশালায় পড়াশোনা করেন। বনগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে তিনি অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষা লাভ করেন। শিক্ষাজীবনে তার আগ্রহ ও প্রতিভার পরিচয় মেলে, যা পরবর্তীতে তার সাহিত্যজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিবাহ
বিভূতিভূষণের প্রথম বিবাহ ১৯১৯ সালে হুগলী জেলার জাঙ্গীপাড়ায় ঘটে। তার স্ত্রী গৌরী দেবী, বিয়ের এক বছর পর মারা যান, যা বিভূতিভূষণের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এরপর ১৯৪০ সালে তিনি ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে রমা দেবীর সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাকনাম বাবলু।
কর্মজীবন
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষকতার পেশায় প্রবেশ করেন এবং বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকেন। তিনি গোরক্ষিণী সভার প্রচারক হিসেবে বাংলা, ত্রিপুরা ও আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে সেক্রেটারি ও গৃহশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং পরে বনগাঁর গোপালনগর হরিপদ ইনস্টিটিউশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি আমৃত্যু এই স্কুলেই কর্মরত ছিলেন এবং তার সাহিত্যকর্মের জন্য পরিচিতি লাভ করেন।
সাহিত্যকর্ম
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯২১ সালে ‘উপেক্ষিতা’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। ১৯২৫ সালে তিনি ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের লেখার কাজ শুরু করেন, যা ১৯২৮ সালে সম্পন্ন হয়। এই উপন্যাসটি পরবর্তীতে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র “পথের পাঁচালী” হিসেবে রূপায়িত হয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে। বিভূতিভূষণের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল ‘অপরাজিত’, ‘আরণ্যক’, ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘ইছামতী’, ও ‘অশনি সংকেত’।
গ্রন্থতালিকা
উপন্যাস:
- পথের পাঁচালী (১৯২৯)
- অপরাজিত (১ম ও ২য় খণ্ড, ১৯৩২)
- দৃষ্টিপ্রদীপ (১৯৩৫)
- আরণ্যক (১৯৩৯)
- আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০)
- বিপিনের সংসার (১৯৪১)
- দুই বাড়ি (১৯৪১)
- অনুবর্তন (১৯৪২)
- দেবযান (১৯৪৪)
- কেদার রাজা (১৯৪৫)
- অর্থৈজল (১৯৪৭)
- ইছামতি (১৯৫০)
- অশনি সংকেত (অসমাপ্ত)
গল্প-সংকলন:
- মেঘমল্লার (১৯৩১)
- মৌরীফুল (১৯৩২)
- যাত্রাবদল (১৯৩৪)
- জন্ম ও মৃত্যু (১৯৩৭)
- কিন্নর দল (১৯৩৮)
- বেণীদির ফুলবাড়ি (১৯৪১)
- নবাগত (১৯৪৪)
- তালনবমী (১৯৪৪)
- উপলখন্ড (১৯৪৫)
- বিধুমাস্টার (১৯৪৫)
- খণ্ডচাঁদের বক্রতায় (১৯৪৫)
- অসাধারণ (১৯৪৬)
- মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৪৭)
- আচার্য কৃপালিনী কলোনি (১৯৪৮; ১৯৫৯ সালে ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব’ নামে প্রকাশিত)
- জ্যোতিরিঙ্গণ (১৯৪৯)
- কুশল-পাহাড়ী (১৯৫০)
কিশোরপাঠ্য:
- চাঁদের পাহাড় (১৯৩৮)
- আইভ্যানহো (১৯৩৮)
- মরণ-ডঙ্কা বাজে (১৯৪০)
- মিসমিদের কবচ (১৯৪২)
- হীরা মাণিক জ্বলে (১৯৪৬)
- সুন্দরবনের সাত বৎসর (১৯৫২)
ভ্রমণকাহিনী ও দিনলিপি:
- অভিযাত্রিক (১৯৪০)
- স্মৃতির রেখা (১৯৪১)
- তৃণাঙ্কুর (১৯৪৩)
- ঊর্মিমুখর (১৯৪৪)
- বনে পাহাড়ে (১৯৪৫)
- উৎকর্ণ (১৯৪৬)
- হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮)
মৃত্যু
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার শেষকৃত্য সুবর্ণরেখা নদীর ওপরে ‘পঞ্চপাণ্ডব ঘাট’-এ সম্পন্ন হয়। তার বাড়িটি স্ত্রীর নামে ‘গৌরীকুঞ্জ’ হিসেবে পরিচিত এবং সামনের রাস্তা ‘অপুর পথ’ হিসেবে পরিচিত।
পুরস্কার ও সম্মাননা
বিভূতিভূষণের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। তার উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হল রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫১) মরণোত্তর ইছামতী উপন্যাসের জন্য। তার জন্মস্থান বনগাঁর পারমাদান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নাম ‘বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য’ হিসেবে রাখা হয়েছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম তার কাল্পনিক শক্তি, জীবনবোধ এবং বাংলার গ্রামীণ জীবনচিত্রের গভীর প্রতিফলন। তার রচনা বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত।