বিহারীলালকে ভোরের পাখি বলা হয় কেন: বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪) ছিলেন বাংলা সাহিত্যের আদি রোমান্টিক গীতিকবি এবং প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও মানবিক আবেগের একনিষ্ঠ সাধক। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে কলকাতার জোড়াবাগানে জন্মগ্রহণকারী এই কবি বাংলা গীতিকবিতার ঐতিহ্যে এক নতুন ধারার সূচনা করেন। তার কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম, সৌন্দর্য ও মানবিক আবেগের এক বিশেষ রস প্রকাশ পেয়েছে, যা পূর্বসূরি কবিদের থেকে আলাদা। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে “ভোরের পাখি” আখ্যা দিয়েছিলেন।
ভোরের পাখি উপাধি ও রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিহারীলালকে “ভোরের পাখি” নামে অভিহিত করেন কারণ বিহারীলালের কাব্যধারা ছিল বাংলা গীতিকবিতার জগতে প্রথম রোমান্টিকতা ও আন্তরিকতার সুরের আভাস। রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন, বিহারীলাল “নিজের ছন্দে মনের কথা” বলতেন; তিনি কোনো যোদ্ধামূলক মহাকাব্য বা উদ্দীপনাপূর্ণ দেশানুরাগী কবিতা রচনা করেননি। বরং, তিনি নিভৃতে বসে নিজের ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, যা পাঠকের হৃদয়ে সহজেই সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন, “সে প্রত্যুষে অধিক লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্জে বিচিত্র কলগীত ভূজিত হইয়া উঠে নাই। সেই উষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুরে গান ধরিয়াছিল।”
বিহারীলালের কাব্যের বৈশিষ্ট্য: বিহারীলালের কবিতায় প্রকৃতির স্নিগ্ধতা, মুগ্ধতা, এবং আন্তরিক আবেগ প্রকাশ পেয়েছে। রেনেসাঁস যুগের তপ্ত ব্যস্ততাময় কাব্য ধারার বিপরীতে বিহারীলালের কবিতা ছিল অন্তর্মুখী ও আত্মনিষ্ঠ। তার কাব্যে ভোরের মৃদু আলো, পাখির কলরব, প্রকৃতির সরল সৌন্দর্য এবং মানবিক সম্পর্কের কোমল অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। তার কবিতাগুলো নতুন ধারা গড়ে তোলে, যেখানে অন্তরের বেদনাবোধ ও মানবিক কল্যাণের প্রতি এক ধরনের স্পষ্ট ও সংবেদনশীল মনোভাব দেখা যায়। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘সংগীত শতক’ (১৮৬২), ‘বন্ধু বিয়োগ’ (১৮৭০), ‘প্রেম প্রবাহিনী’ (১৮৭০), ‘বঙ্গসুন্দরী’ (১৮৭০) ইত্যাদি।
বাংলা গীতিকবিতায় বিহারীলালের অবদান: বিহারীলালের কবিতায় বাংলা সাহিত্যের যে “সাধকের সুর,” সেই সুর রবীন্দ্রনাথের আগমনের পূর্বে গীতিকবিতায় এক নতুন দিক নির্দেশনা প্রদান করে। তার কবিতায় অন্তরচেতনার প্রকাশ, প্রকৃতিপ্রেম এবং গভীর মানবিক উপলব্ধি বাংলা গীতিকবিতাকে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। এজন্য তাকে আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়।
সুতরাং, বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক গীতিকবিতার এই নতুন ধারার সূচনা করেই বিহারীলাল চক্রবর্তী “ভোরের পাখি” হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়েছেন।