সোনার তরী কাব্যের প্রথম কবিতা ‘সোনার তরী’। এ কবিতার বাইরের অর্থ পর্যালোচনায় দেখা যায় এখানে প্রধান ঘটনা কৃষক ও কৃষি ফসল ধান। কৃষক তার খেতের সমস্ত ধান তুলে দিয়েছে নৌকায়। ভরে গেছে নৌকাখানি। ধান বোঝাই নৌকাতে কৃষক নিজেই রয়েছে। প্রত্যাশা করেছে আশ্রয়ের। কিন্তু তা সম্ভব হলো না। স্থান হলো না তার নিজের, সোনার ফসল নিয়ে চলে যায় নৌকা। কৃষককে সঙ্গে নেয় না সে। বাহ্যিক এই অর্থটুকু কবিতার রূপকধর্মী অর্থের একটি অর্থরূপে গৃহীত। কিন্তু এই অর্থই কবিতার সব নয়। কবিতার মধ্যে আছে আরও এক গূঢ় অর্থ, সেই অন্তর্নিহিত অর্থেই ‘সোনার তরী’ কাব্যের চূড়ান্ত সার্থকতা। কবিতার রূপকধর্মী অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সমালোচক বলেছেন—‘সোনার তরী’ কবিতার রূপকার্থটির মধ্যে নিহিত রয়েছে এর প্রাণৈশ্বর্য। কবির লেখা বিভিন্ন পত্রে এর অন্তর্নিহিত গূঢ়ার্থের দিকটি উপলব্ধি করা যায়। সৃষ্টি কর্মে নিয়োজিত কবি। নিরন্তর প্রকাশ ব্যাকুল চিত্ত নিয়ে সৃষ্টির কাজে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন, রাশি রাশি সৃষ্টি সম্ভারে ভরে দিয়েছেন সাহিত্য সরস্বতীর ভাণ্ডারকে। নিঃশ্বেষে সবকিছু সঁপে দিয়ে নিজের স্থান খুঁজেছেন তিনি। কিন্তু সেখানে ব্যর্থতার সুর ঝঙ্কৃত হয়েছে, তাঁকে থাকতে হয়েছে একা। নৌকা তার সমস্ত সৃষ্টি কর্ম ভরা দিয়ে পাল তুলে বয়ে চলেছে, শুধু পড়ে রইলেন কবি নিজে।
রূপক ধর্মী এ কবিতা। এর অর্থ দুটি, একটা গৌণ আর একটি মুখ্য। গৌণ অর্থে কৃষক ও কৃষিজাত ফসলের কথা এসেছে এবং মুখ্য এসেছে কবির কাব্য ফসল এবং এসেছেন কবি স্বয়ং, সৃষ্টির আনন্দে কবি দুহাত ভরে সাহিত্য সরস্বতীকে সবই দিয়েছেন। জীবন ফসল তিনি রেখে গেছেন পর্যাপ্ত পরিমাণে। সৃষ্টি থেকে যাবে কোনো না কোনো আকারে, কিন্তু স্রষ্টার কী হবে? এই জিজ্ঞাসার অনুসরণ রবীন্দ্রনাথের নানা সৃষ্টিতে লক্ষ্য করা গেছে। ‘সোনার তরী’র রূপকার্য বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বিভিন্ন পত্রে লিখেছেন—“সংসার আমাদের জীবনের সমস্ত কাজ গ্রহণ করে। কিন্তু আমাদিগকে তো গ্রহণ করে না। আমার চিরজীবনের ফসল যখন সংসারের নৌকায় বোঝাই করিয়াই দিই, তখন মনে এই আশা থাকে যে, আমারও এই সঙ্গে স্থান হবে। কিন্তু সংসার আমাদিগকে দুই দিনেই ভুলিয়া যায়।” কবি বারবার সবকিছু দানের প্রতিদানে তাঁকে মনে রাখার সকরুণ অনুরোধ রেখেছেন। কিন্তু বাস্তবের নির্মম নিষ্ঠুরতায় তা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। আমি খাটিতেছি, তোমাকে দিয়াই আমার সুখ। আমার সমস্তই লও। কিন্তু আমাকে ঠেলিও না, আমাকে ভুলিও না, আমার কাজের মধ্যে আমার চিহ্নটুকু যত্ন করিয়া রাখিয়া দিও। এই কবিতার রূপকার্যে এই সত্যই সুপরিস্ফুট।
সব দানের প্রতিদানেও কবিচিত্তকে একাকীত্বের অতল স্পর্শে স্বাতন্ত্র্যের ইতিবৃত্ত গড়তে হয়। সব চলে যায় তার কিন্তু তাঁকে পড়ে থাকতে হয় নিঃসঙ্গ নির্জনতার মধ্যে। মেঘমেদুর ঘনবর্ষার দিকে কূলে একা বসে থাকতে হয় তাঁকে। যেন কত অসহায় তিনি। দেখতে থাকেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্ত লীলা। এপারেতে ছোটো খেতে বসে থাকতে হয় তাঁকে একলা। সকরুণ অনুরোধ বারবার বর্ষিত হয় কিন্তু সাড়া মেলেনি সেই অনুরোধে সোনার তরী এসে সব নিয়ে যায় তাঁর। কিন্তু তাঁকে নেওয়ার ব্যাপারে প্রত্যুত্তর ধ্বনিত হয়— তাঁর এই সৃষ্টি সম্পদ ভরে দিয়েছে ক্ষুদ্র সোনার তরীটিকে। তাই বিষণ্ণতার বেদনা বিবশ অবস্থা পরিস্থিতিটি সঙ্গী করে কবিকে একলা পড়ে থাকতে হয়। প্রাচীন বাংলার আদি সৃষ্টি ‘চর্যাপদে’ ও বহু বছর পূর্বে তখনকার কবি কণ্ঠে এমনি সুর এমনি খেদ ধ্বনিত হয়েছিল—
‘খেনে ভরিলে করুণা নারী।
রূপা যোই নাহিক ঠাবি।’
অর্থাৎ এই মায়াময় সংসার তরীতে অমূল্য সম্পদ সবই ভরা দেওয়া হয়েছে কিন্তু অল্প মূল্যের জিনিসকে রাখার সেখানে কোনো স্থান নেই। মহাকাশ এমনই নিষ্ঠুর, নির্মম।
বিষাদময়তার এক ছবি আছে এ কবিতায়। সকালবেলায় আকাশের মেঘাচ্ছন্ন দিক তার পরিবেশ গড়ে তুলেছে। থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে মেয়ের গুরু গুরু গর্জন। নদীর ওপারে দূরের গ্রামগুলি যেন অস্পষ্ট ঝাপসা। কবি একাকী তাঁর নির্জন খেতে কর্মব্যস্ত, খেতের পাশে বয়ে চলেছে ক্ষরস্রোতা এক ক্ষুদ্র নদী। শুরু হয়ে গেল বর্ষণ। উদাসী মাঝিকে দেখলেন কবি। কণ্ঠে তার গান। কবির মনে হল সে বুঝি একান্ত পরিচিত। তরীকে কূলে ভেড়ানোর অনুরোধ রাখলেন তিনি, কষ্টার্জিত ফসলগুলি তুলে দিলেন মাঝির নৌকায়। কবির ফসলগুলি নিয়ে মাঝি চলে গেল, কবির ব্যাকুল প্রার্থনার মূল্য না দিয়ে। উদাসী মাঝি কবির আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল, তরী এনেছিল এবং তাঁর কষ্টের ফসলগুলিকে নৌকাতেও তুলে নিয়েছে কিন্তু সে নৌকায় কবির কোনো স্থান হল না। কবিচিত্তে দুঃখের মধ্যেও সান্ত্বনা এখানে যে তাঁর সোনার ফসল নষ্ট হয়নি। কষ্টার্জিত ফসল নষ্ট হলে তাঁর চিত্তলোকে জেগে উঠত বিষাদময় বেদনার দাবদাহ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি বিচিত্রমুখী তাঁর প্রতিভা, কেবল কবিতার জন্যই তিনি বিপুলভাবে নন্দিত। তাঁর সৃষ্টির সাফল্যের মূলে রূপকার্যের গুরুত্ব অপরিসীম। রূপকের রাজপ্রাসাদ গড়েছেন তিনি তার বহু সৃষ্টি সম্পদের মধ্যে, ‘সোনার তরী’ কবিতাটি সেই ধারায় অভিষিক্ত হয়ে অসম্যতা লাভ করেছে।
‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের ‘তরী বোঝাই’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখাটিতে কবি সোনার তরীর প্রসঙ্গটি টেনে এনে যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন তার সারমর্ম হল—সোনার তরী বলে যে কবিতাটি লেখা হয়েছিল তার একটি নির্দিষ্ট অর্থ আছে, মানুষ সমস্ত জীবন ফসল চাষ করছে, তার জীবনের খেতটুকু দ্বীপের মতো, চারদিকেই অব্যক্তের দ্বারা বেষ্টিত, ওই একটুখানি তার কাছে ব্যক্ত হয়ে আছে—যখন কাল ঘনিয়ে আসছে, যখন চারদিকে জল বেড়ে উঠছে, যখন আবার অব্যক্তের মধ্যে তার ওই চরটুকু তলিয়ে যাবার সময় হল, তখন তার সমস্ত জীবনের কর্মের যা কিছু নিত্য ফল তা সে ওই সংসারের তরণীতে বোঝাই করে দিতে পারে। সংসার সমস্তই নেবে একটি কণাও ফেলে দেবেনা। কিন্তু যখন মানুষ বলে—ওর সঙ্গে আমাকেও নাও, তখন সংসার বলে তোমার জন্য জায়গা কোথায়? তোমাকে নিয়ে আমার কী হবে? অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু না কিছু দান করছে, সংসার সমস্ত গ্রহণ করছে, কিন্তু মানুষ যখন সেই সঙ্গে তার অহংকে চিরস্থন করে রাখতে চাইছে তখন তার চেষ্টা বিফলে পর্যবসিত হচ্ছে, সোনার তরী হল সেই সংসার—সব নেবে কিন্তু মানুষকে নেবে না।
সর্বোপরি, সৃষ্টির কাছ থেকে যখন সৃষ্টির ব্যাখ্যা মেলে তার চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’ কবিতার যেমন স্রষ্টা, তেমনি তিনি নিজেই এ কবিতার ব্যাখ্যা কর্তা। কবি নানা প্রসঙ্গে সোনার তরী কবিতার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার মাধ্যমে কবিতাটি নানাদিকে যথার্থ স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়ে যায় রস তথা সৌন্দর্য বনসৃষ্টির যে কবিতার মূল আবেদন সে কথাকে স্বীকৃতি দিয়ে তাই কবির এ কবিতা প্রসঙ্গে চূড়ান্ত মূল্যায়ন “কবিতার রস এই ব্যাখ্যার ওপরেই যদি নির্ভর করে তবে ইহা বৃথাই লিখিত হইয়াছিল। মনে করো না কোনো বিশেষ অর্থ নাই, কেবল বর্ষা, নদীর চর, কেবল মেঘলা দিনের ভাব, একটা সংগীত মাত্র যদি হয় ক্ষতি কী? তত্ত্ব ব্যাখ্যাকে দূরে সরিয়ে কবি এই রস ব্যাখ্যা দিয়ে আত্মসত্তুষ্ট হতে চেয়েছিলেন। আশা করা যায় পাঠকও তাই সন্তুষ্ট।