সোনার তরী কাব্যে বিচিত্র চিন্তার মধ্যে বৈশ্ববীর চিন্তা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ভারতীয় সংস্কৃতির পৌরাণিক ধারা কবিসৃষ্টির বিভিন্ন পর্বে লক্ষ্য করা যায়। সোনার তরী বিধৃত ঝুলন ও বৈব কবিতা দুটি আমাদের বর্তমান আলোচনার সহায়ক হবে।
ঝুলন প্রসঙ্গে আমাদের স্বতঃই মনে আসে নন্দনন্দন কৃষ্ণ ও বৃষভানুরাজনন্দিনী রাই কিশোরীর অসংখ্য লীলার মধ্যে অন্যতম ঝুলনের কথা। বৃন্দারণ্যে কদম্বকুঞ্জে শ্রাবণের পূর্ণিমা রজনিতে কৃষ্ণ-রাধা ঝুলনায় ঝুলে ছিলেন; এখনো হিন্দুগণ বিশেষত বৈষ্ণুবসম্প্রদায় রাধা-কৃষ্ণের এই ঝুলনোৎসব দেবালয়ে দেবালয়ে পালন করেন।
ঝুলন কবিতায় দ্বাপরের সেই পরিবেশকে অক্ষুণ্ণ রেখে রবীন্দ্রনাথ একটি রূপকাত্মক ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন, এখানে কবি আমি তাঁর প্রাণ রাধাকে নিয়ে মরণ খেলায় ঝুলন লীলায় মেতেছেন। কৃষ্ণকে বিবৃত অবতার রূপে ও রাধারাণীকে মহাভাবস্বরূপা বলে ভক্ত বৈঘ্নববৃন্দ যতই ভাবুন না কেন, ‘কৃষ্ণের যতেক লীলা যে ‘সর্বোত্তমনরলীলা’ এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সন্দেহ ছিল না। সহপাঠী রবীন্দ্রনাথের স্মরণে নিশ্চয়ই ছিল—
কৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা
নববপু তাহার স্বরূপ।
গোপবেশ বেণুকর নব কিশোর নটবর
নরলীলার হয় অনুরূপ।
রবীন্দ্রনাথের ঝুলন কবিতায় তাঁর ও তাঁর প্রাণের মধ্যে এই অলৌকিক লীলার আবেশ ঘটিয়ে নরলীলাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন; বৈষ্ণুবভাবনার মধ্যে মানবীভবন ঘটিয়েছেন।
বৈষ্ণব কবিতা তথা পদাবলির মধ্যে কিছু বৈক্ষ্ণবভক্ত অলৌকিকত্ব দেখলেও রবীন্দ্রনাথ তা স্বীকার করেন না। শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈবের গান—এ কথায় কবিতামুখ প্রতিবাদ বৈষ্ণুব কবিতা। সোনার তরী পর্বে এসে গ্রাম-জনপদজীবনের মানুষের নৈকট্য ও সাহচর্য্য লাভ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নবজাগ্রত জগৎ-প্রীতি ও মানব-মমতা থেকে উৎসারিত তাঁর বৈক্ষ্ণব কবিতা। মাটির মানুষের প্রতি ভালোবাসার পথ ধরেই যে বৈকুণ্ঠের ভগবানের লক্ষ্যে যাত্রা করতে হয় সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তাঁর পঞ্চভূত-মানুষ প্রবন্ধে— “যাহাকে আমরা ভালোবাসি কেবল তাহারই মধ্যে আমরা অন্তরের পরিচয় পাই। এমনকি জীবনের মধ্যে অন্তরকে অনুভব করার অন্যনাম ভালোবাসা। প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্য-সম্ভোগ। সমস্ত বৈবধর্মের মধ্যে এই গভীর তত্ত্বটি নিহিত রহিয়াছে। বৈবধর্ম সমস্ত প্রেমসম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করতে চেষ্টা করিয়াছে। যখন দেখিয়াছে, মা আপনার সন্তানের মধ্যে আনন্দের আর অবধি পায়না, সমস্ত হৃদয়খানি মুহূর্তে-মুহূর্তে ভাঁজে ভাঁজে খুলিয়া ওই ক্ষুদ্র মানবাঙ্কুরটিকে সম্পূর্ণ বেষ্টন করিয়া শেষ করিতে পারে না, তখন আপনার সন্তানের মধ্যে আপনার ঈশ্বরকে উপাসনা করিয়াছে। যখন দেখিয়াছে প্রভুর জন্য দাস আপনার প্রাণ দেয়, বন্ধু আপনার স্বার্থ বিসর্জন করে, প্রিয়তম এবং প্রিয়তমা পরস্পরের নিকট আপনার সমস্ত আত্মাকে সমর্পণ করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠে তখন এই সমস্ত প্রেমের মধ্যে একটা সীমাতীত ঐশ্বর্য অনুভব করিয়াছে।”
রবীন্দ্রপাঠক বর্গ জানেন বৈশ্বব পদাবলী সাহিত্যের সঙ্গে কি নিবিড় অনুরাগ ছিল। প্রেমের বিভিন্ন পর্যায় তথা পদাবলি বিভাজনের কথা—পূর্বরাগ অনুরাগ, মান-অভিমান,/অভিসার, প্রেমলীলা, ‘বিরহ মিলন’ প্রমুখ ‘বৃন্দাবন গাথা’ রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বৈক্ষ্ণব কবিতার একেবারে প্রারম্ভেই উল্লিখিত হয়েছে। রাধাকৃষ্ণের বিচিত্র প্রেমলীলার সঙ্গে কালিন্দী, যমুনা, শ্রাবণী ও নীল নিকুঞ্জের খেলা যে ঘনিষ্ঠ ছিল তাও রবীন্দ্রউল্লেখের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয়েছে আর একবার। রাধাকৃষ্ণের গোপন মিলনের সাক্ষীস্বরূপ কালিন্দীর ভূমিকা অনেক। বলা যেতে পারে কালিন্দী পটভূমি পরিবেশই রাধাকৃষ্ণের মিলন বিরহের উদ্দীপন বিভাররূপে কাজ করেছে। একদা যে কালি নন্দী যমুনার কূলে মেঘমেদুর অম্বর তলে তমাল-কদম্ব মূলে রাধাকৃষ্ণের মিলন-কেলি-শয্যা রচিত হয়েছিল সেই কালিন্দীর জলরাশি কৃষ্ণের জন্য মাথুরবিরহে রাধা-প্রধানা আভার-রমণীর অশ্রুবারিতে হয়েছিল বৰ্দ্ধিত— ‘কিস্তৃেকা যমুনা কুরঙ্গনয়না নেত্রাম্বুভির্বর্ধত।’ জ্যোৎস্নাভিসার দিবাভিসার প্রভৃতি বিবিধ অভিসারের কথা বৈষ্ণুব মহাজনগণ রচনা করলেও শতবিঘ্নময়ী শ্রাবণরজনির অভিসার তুলনারহিত।
রবীন্দ্রনাথ লিখলেন তাঁর বৈষ্ণুবকবিতা শীর্ষক কবিতায়—
এই প্রণয় স্বপ্ন
শ্রাবণের শর্বরীতে কালিন্দীর কূলে
চারি চক্ষে চেয়ে দেখা কদম্বের মূলে
শরমে সম্ভ্রমে
এর পরেই তাঁর বিস্ময়গর্ভিত বাক্য, নাকি প্রশ্ন ‘একি শুধু দেবতার।’
বৈষ্ণুবীয় চিন্তায় অলৌকিকতাকে রবীন্দ্রনাথ মানবীকরণ করলেন, করলেন সাধারণীকরণ লৌকিক বাসনায় বসিত করার জন্য তাঁর যুক্তি—
হেরি কাহার নয়ান
রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে?
বিজন বসন্তরাতে মিলন শয়নে
কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে
আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে
রেখেছিল মগ্ন করি।
সোনার তরী পর্বে এসে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে পদ্মাতীরবর্তী গ্রামজনপদের একেবারে মাটির মানুষের কাছে এসেছিলেন; কবিহৃদয়ের সহজাত মর্ত্যমমতা মানবপ্রীতিতে সুবলিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বৈবমহাজন কাব্যের অলৌকিকতা রবীন্দ্রচিত্তাস্পর্শে লাভ করেছে নবরাগ, অভিনব দ্যুতি।
সোনার তরী কাব্যের বৈবভাবনা প্রসঙ্গে আর তিনটি কবিতা উল্লেখ–বর্ষাযাপন, ব্যর্থযৌবন ও হৃদয়যমুনা।
রাজধানী কলকাতার তেতালার ছাতে কবির কঠোর কুঠরির একধারে সমাগত ঘন ঘোর বর্ষা কি করে কাটিয়েছিল তার ছন্দায়িত প্রকাশনা বর্ষাযাপন। মেঘদূত পড়ার পর রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণুবমহাজন গোবিন্দদাসের পদাবলি পড়েছেন বর্ষা আসে ঘনরোলে/যত্নে টেনে নিই কোলে/গোবিন্দদাসের পদাবলি। কবি গীতগোবিন্দের মেখৈর্মেদুরমম্বরও স্মরণ করেছেন, উল্লেখ করেছেন ‘রজনি শাওন ঘন ঘন দেয়া গরজন’ ও ‘পালঙ্কে শয়ানরঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে’ ইত্যাদি বৈব মহাজন বচন।
ব্যর্থযৌবন কবিতাটি অনামিকা কোনো নায়িকার বিলাপিকা। বৈব নন্দনশাস্ত্রে যে অষ্ট অবস্থার নায়িকার লক্ষণ ও পরিচয় পাই, তাতে বর্তমান কবিতার নায়িকা বিপ্রলম্বা। নায়িকা প্রিয়মিলনোদ্দেশ্যে যথোচিত বসন ভূষণমণ্ডলে সজ্জিতা হয়ে এসেছিল অভিসারে। এখন বঞ্চিত হয়ে বিলাপ করছে সে।
সমগ্র কবিতাটির পরিমণ্ডল বৈশ্ববমহাজন কল্পনার। এখানে বেশভূষণ আছে, আছে কুসুমমাল্য। এখানে রজনি আছে, আছে বিরহ শয্যা। এখানে যমুনা আছে, আছে অভিসার এখানে তরুমর্মর আছে, আছে নদীকলতান। এখানে কুঞ্জদুয়ার আছে, আছে বঞ্ছিতার বেদনা। আর আছে সমপ্রাণ সখী। বৈষ্ণবপদাবলী-সুলভ ললিত পদচয়ন ও ছন্দোবন্ধন পাঠককে মুগ্ধ করে। কবিতার ‘আমি’ যে রাইকিশোরীতে রূপ পায় তাতে সন্দেহ থাকে না। বিশেষ যখন সে বলে—
আমি বৃথা অভিসারে এ যমুনা পারে
এসেছি।
বহি বৃথা মনো আশা এত ভালোবাসা
বেসেছি।
শেষে নিশি শেষে বদনমলিন
ক্লান্তচরণ, মন উদাসীন,
ফিরিয়া চলেছি কোন্ সুখহীন
ভবনে।
হায় যে-রজনি যায় ফিরাইব তায়
কেমনে।
‘হৃদয়ে-যমুনা’তেও বৃন্দাবনপরিবেশ সুস্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ হৃদয়কে যমুনার সঙ্গে অভেদকল্পনার প্রতীতিতে এনেছেন। এখানে কুম্ভ ভরে নেওয়ার কথা আছে, বর্ষা গাঢ়তম আছে জলদমেঘের তীরে তীরে নেমে আসা। নায়িকা একলিকা, তবে তাঁর আগমন নিঃশব্দসারে নয়, নুপুরের ঝিনিকিঝিনিতে বাহিত। এখানে নবনীল নভস্তল আছে, শ্যাম দুর্বাদল আছে, ‘আছে বিকশিত বনস্থল বিকচফুলে। সুনীল সলিলা যমুনার কূল আছে কুঞ্জ তৃণাসন আছে, বঞ্জুলবন আছে, আছে নীলাম্বরী। এসবই সহৃদয় পাঠককে বৈষ্মবপদাবলী স্মরণ করাবে, বিশেষ স্মরণ করাবে জয়দেব গোস্বামীর—‘মেঘৈমেদুরমম্বরম্ বনভুবঃ শ্যামস্তমালফ্লুমৈঃ এবং মঞ্জুল বঞ্জুল কুঞ্জবনম্’ ইত্যাদি বাক্য ও বাক্যাংশ।