Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

সোনার তরী কাব্যের লিরিক ও রোমান্টিক ভাবনা প্রসঙ্গে লিখুন

ভারতীয় নন্দন শাস্ত্রে কাব্য শ্রেণি বিভাগে গীতি-কাব্য সম্পর্কে কোনো সংজ্ঞা সূত্র নেই। শ্রব্য-কাব্যের অন্তর্গত যে খণ্ড-কাব্য বিভাগ আছে, আমরা মনে করি সেগুলি পাশ্চাত্যের লিরিক-কাব্যের সমধর্মী। পাশ্চাত্যে lyre নামে এক বীণা জাতীয় সংগীত যন্ত্র বাজিয়ে যে প্রেম-বিরহ বিষাদের গান গাওয়ার প্রচলন, সেখান থেকেই Lyric কথাটির উদ্ভব। Lyric-এর ভারতীয় সাহিত্যে অনুবাদ বিশেষ হল গীতি-কবিতা। এখানে অবশ্য উল্লেখ করতে হয় সংস্কৃত-সাহিত্যে গীতি-কবিতার অবলম্বন বিষয় কেবল প্রেম বা বিরহ, বিষাদ না বেদনা নয়: দেবস্তুতি, মোক্ষ ইত্যাদিও অবলম্বন বিষয়।

গীতি-কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য, তাতে সুখ-দুঃখ প্রভৃতি কবির ব্যক্তিগত জীবনকথা প্রকাশিত হয়। এই ব্যক্তিগত জীবন-কথাকে ইংরেজিকে বলা হয় Subjectivity বাংলায় মন্ময়ত্ব। এই ব্যক্তিশীল জীবনের কথা অখিলজীবন চেতনার সঙ্গে মিশে সার্বজনীন আবেদন হয়ে ওঠে একান্ত হৃদয়-বেদ্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রবল আবেগ, অনুভূতির প্রগাঢ়তা ইত্যাদি।

এখানে উল্লেখ করতে হবে গীতি-কবিতার সঙ্গে রোমান্টিসিজম-এর ঘনিষ্ঠ যোগ থাকে। রোমান্টিসিজম্‌কে ভাবাবেগ প্রবণতা অভিধায় অভিহিত করা হয়। তবে রোমান্টিসিজম্ বলতে একটা বিশিষ্ট সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায় যেখানে থাকে সমুন্নত কল্পনার বিলসন, সৌন্দর্য রাজ্যে প্রতি আকর্ষণ, প্রকৃতির প্রতি এক গভীর প্রীতি, বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মবোধ-স্পৃহা, ভাবগত অখণ্ড সৌন্দর্যের জন্য আকুলতা ইত্যাদি। প্রকৃতি ও মানব জীবনের মধ্যে রোমান্টিক কবি-মন অপার্থিব, অলৌকিক সৌন্দর্য দেখতে পায়। অতি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ বস্তু যেমন তৃণা, লতা, পাতা, গাছ, পাখি, গ্রাম, লোকালয় প্রভৃতি রোমান্টিক কবির দৃষ্টিতে হয়ে ওঠে অপরূপ তাৎপর্য-যুক্ত ও সুষমা সুন্দর। সাধারণ মানুষ ও প্রকৃতি জগৎকে রোমান্টিক বা ভাবাবেগের কবি দেখেন বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে। প্রকৃতি ও মানব জগৎ বিশেষ সৌন্দর্যে গৌরবে ও মহিমায় হয় বিমণ্ডিত।

রবীন্দ্রনাথ যে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ গীতি-কবি সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। রবীন্দ্রনাথের গীতি-কাব্য-মানসের পরিচয় তাঁর প্রথম দিকের রচনাগুলিতে ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ যৌবনের কাব্য ‘সোনার তরী’তে লিরিসিজম্ ও রোমান্টিসিজম-এর লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘সোনার তরী’, ‘ঝুলন’, ‘দুই পাখি’, ‘বসুন্ধরা’, ‘মানস-সুন্দরী’, ‘সমুদ্রের প্রতি’, ও ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় কবির ব্যক্তিলীন জীবন-চেতনা কথা মন্ময়-ভাবনার বিবিধ পরিচয় বিধৃত হয়ে আছে। সেখানে রূপায়িত হয়েছে কবির সৌন্দর্য রাজ্যের এক দূরযাত্রা, অখণ্ড সৌন্দর্যের প্রতি অভিলাষ, বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে একত্ববোধ প্রভৃতি অতিমাত্র কল্পনা-প্রবণ স্বভাব।

কবির ব্যক্তিগত-জীবন ‘সোনার তরী’ কবিতাবলির সঙ্গে কীভাবে যে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবন স্মৃতি’ প্রভৃতিকে প্রকাশ করেছেন।

‘সোনার তরী’ কবিতার ‘আমি’ কবি নিজে। নিজের কর্মক্ষেত্রে নানাবিধ বাধা-বিঘ্নের মধ্যে কবি-সাধনার যে শ্রেষ্ঠধন অর্জন করেছেন তা তিনি অমরত্বের জন্য নিজ জীবন দেবতাকে অর্পণ করে শেষে নিজেকেও অর্পণ করতে চান। কিন্তু কবিকে তাঁর জীবন দেবতা যখন অমরত্ব প্রদানের জন্য গ্রহণ করলেন না তখন কবি হয়ে পড়েছেন বিষাদে বিমগ্ন। যদি সোনার ধানকে খণ্ড সৌন্দর্য ও সোনার তরীকে অখণ্ড সৌন্দর্যের অক্ষয় আধার মনে করা হয়, তবুও কবির ব্যক্তিগত চিন্তা অক্ষুণ্ণ থাকে। ‘ঝুলন’ কবিতায় ঝুলনারোহী দুজন—কবি স্বয়ম্ এবং তাঁর প্রাণরুপিণী বধূ । সুখ-প্রাচুর্যে, বিলাস-বাহুলে কবির যে প্রাণ দৃঢ়তা কর্মনিষ্ঠতা ইত্যাদি হারিয়ে ফেলেছে আঘাত-সংঘাতের মধ্যে, বিপদ-দুঃখের মধ্যে কবিতাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কবি ঘটাতে চেয়েছেন আত্মজাগরণ। তাই কবির আপন জীবন-কথার দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে কবিতাটির গীতি-কাব্য স্বভাব প্রস্ফুট হয়ে উঠেছে। আপন বাল্য-কৈশোরের ঠাকুরবাড়ির ভৃত্য ও কর্মচারিদের তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রনাথকে অতিনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় দিন কাটাতে হয়েছিল। প্রকৃতির হাতছানিতে সাড়া দিতে পারেননি। দূরের নীল আকাশ, গাছ পালা ইত্যাদি তাঁর কাছে গভীর আকর্ষণ তুলে ধরলেও তিনি উন্মুক্ত প্রকৃতির স্পর্শ লাভ করতে পারেননি। আমরা স্পষ্ট মনে করতে পারি ‘দুই পাখি’তে ‘খাঁচার পাখি’ হল সেই দিনগুলোর রবীন্দ্রনাথ। ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় কবিরই যুগ-যুগান্তর ব্যাপিনী, জন্মজন্মান্তরগামিনী মর্ত্যমমতা প্রকাশিত হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর প্রতি কবির গভীর ভালোবাসা ‘সমুদ্রের প্রতি’ কবিতায়। ‘সোনার তরী’ কবিতার মাঝি যেমন কবির জীবনদেবতা, ‘মানসসুন্দরী’র মানসসুন্দরী যেমন কবির জীবননিয়ন্ত্রী, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, কবিতায় মোহিনী নাবিকা তেমনি কবির জীবনপরিচালিকা শক্তি।

ভৃত্য ও কর্মচারিগণ কঠোর তত্ত্বাবধানে থেকে, কলকাতার নাগরিক সভ্যতায় দিন কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাঙ্ক্ষিত প্রকৃতির স্পর্শ পাননি বহুকাল। পদ্মা নদীর পরিমন্ডলে এসে রবীন্দ্রনাথ লাভ করলেন রূপবতী প্রকৃতির রূপ-রস গন্ধ-শব্দ স্পর্শময় আবেশ। নদী পদ্মা তার বালুচর, ওপরের মুক্ত আকাশ, উদার বাতাস, চরের কৃষকদের শস্যক্ষেত্র, গ্রাম তরুবীথি প্রভৃতি দেখে কবিমন হয়ে উঠল সৌন্দর্য থেকে সৌন্দর্যান্তরের অভিসারী। কবি এই প্রথম সাধারণ নর-নারীর লোকালয়ের কাছাকাছি এলেন। পদ্মা হয়ে উঠল কবি-প্রেমিকা কবি কতবারই না এই পদ্মার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন ঋতুপর্যায়ে। পদ্মাতীরের ছোটো খেত, তার চারদিকে বাঁকাজলের খেলা, ভোরবেলাকার ‘তরুছায়া মসীমাখা গ্রামখানি, কৃষিপল্লি, নদীতীরের বৃদ্ধ কৃষাণের জীর্ণ নিভৃতি কুটির ইত্যাদি যত তুচ্ছ, যত ক্ষুদ্ৰ হোক না কেন কবিনেত্রে মোহাঞ্জন দেয় মাখিয়ে।

দূর-সুদূর-চারিণী কবিকল্পনার স্পর্শ পাওয়া যায় কবি রবীন্দ্রনাথ যখন পর্বতশ্রেণি বনস্থলী-মরুভূমি প্রভৃতির ভয়াল-কমনীয় রূপের বর্ণনা দেন, বর্ণনা দেন প্রলয়-ঝঞ্ঝা, তরঙ্গশঙ্কুল অকূল সমুদ্র প্রভৃতির। এইগুলির মধ্য দিয়ে বিশ্বসৌন্দর্যের জন্য কবিচিত্তের ব্যাকুলতা মূর্ত হয়ে ওঠে।

‘সোনার তরী’ কাব্যের কবিতাবলিতে চিত্রিত প্রকৃতি রূপে রূপে রুচিয়া, যদিও তা খন্ডে খন্ডে রূপায়িত। এখানে শ্রাবণমেঘের বর্ষা আছে, শরৎ আছে, আছে হেমন্ত। এখানে গলিতে সুবর্ণকান্তি ঊষা আছে। কনকবর্ণ সন্ধ্যা আছে, আছে সঘনবর্ষার সন্তামসী নিশীথ রজনি। এখানে ঊর্মিমুখর সাগর আছে, সাগরপারের মেঘস্পর্শী অস্তাচলের পাদদেশ আছে, আছে রজনির ঘনায়মান অন্ধকার। ফলকথা, রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রকৃতি প্রেমিকতা ও রোমান্টিক স্বভাবের যথাযথ পরিচয় রেখেছেন, ‘সোনার তরী’র কবিতায়।

‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় প্রস্ফুট বাৎসল্যে, ‘সমুদ্রের প্রতি’ কবিতায় পৃথিবীর প্রতি ‘পৃথিবীর শিশু’ রবীন্দ্রনাথের আকুলতায় ‘বৈষ্মব কবিতায়’ দেবতাকে প্রিয়ের আসনে ও প্রিয়জনকে দেবতার সামনে আসনে প্রতিষ্ঠায় এবং অন্য অন্য কবিতায় কবির মর্ত্যমমতার গভীরতা হয়েছে দ্যোতিত। আমরা মনে করতে পারি প্রকৃতি প্রেমের মতো মর্ত্যমমত্বও রবীন্দ্রনাথের লিরিক-রোমান্টিক চেতনার পরিচয় বহন করে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

মেঘনাদবধ কাব্য ষষ্ঠ সর্গ ব্যাখ্যা

মেঘনাদবধ কাব্য ষষ্ঠ সর্গ ব্যাখ্যা

ষষ্ঠ সর্গের মূল ঘটনা লক্ষ্মণ কর্তৃক মেঘনাদবধ। দৈবাস্ত্র লাভ করবার পর লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের কাছে সেটি কীভাবে পেলেন তা বর্ণনা করে। তিনি জানান লঙ্কার অধিষ্ঠাত্রী দেবী

Read More

ইন্দ্রানী সুত কে?

ইন্দ্রাণী শব্দের অর্থ ইন্দ্রের স্ত্রী। সুত অর্থ পুত্র। ইন্দ্রানী সুত হল ইন্দ্রের পুত্র।

Read More
অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.