‘সোনার তরী’ কবিতাটির নামকরণ সম্পর্কীয় আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কবি এই কবিতার নামেই তাঁর কাব্যের নামকরণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য যে, রবীন্দ্র সাহিত্যের সর্জ্জনায় ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের একটি বিশেষ স্থান আছে; কবি-প্রতিভা যখন মধ্যগগনে সমারূঢ়, তখন ‘সোনার তরী’ কাব্যের রচনা।
‘সোনার তরী’ কবিতার নামকরণ প্রসঙ্গে আলোচনার প্রাক্কালে তার রূপকার্য নির্ণয় অবশ্যই করণীয়। এই কবিতায় কৃষক, চাষ, চাষের জমি বা ছোটো খেত, খেতের চারিদিকে বাঁকা জলের খেলা, সোনার ধান, অকস্মাৎ গান গাইতে আসা নাবিক, সোনার তরী, সোনার তরীতে ধান তুলে দেওয়া, তরীতে স্থান গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার একটি ভাবগত অর্থ রয়েছে।
কৃষক এখানে কবি। চাষ হচ্ছে কাব্য সৃষ্টির চেষ্টা। চাষের জমি বা ছোটো খেত হল কবির জীবন বৃত্ত, সীমিত কর্মক্ষেত্র। বাঁকা জলে ঘেরা ছোটো খেত নানা প্রকার বাধা-বিঘ্নে প্রতি কূলতায় বেষ্টিত কবির জীবন-বৃত্ত বা কর্মভূমি। সোনার ধান কবির কাব্য সাধনার শ্রেষ্ঠফল, শ্রেষ্ঠ কাব্য সম্ভার। খরপরশা ভরানদীতে গান গাইতে গাইতে আসা তরুণ নাবিক হলেন তরঙ্গসংকুল কালপ্রবাহে অক্লেশে পারে উত্তীর্ণ হতে সক্ষম কবির জীবন পরিচালকের জীবন দেবতা। সোনার তরী হল ভয়াল কাল প্রবাহে কবির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে, কাব্য সম্ভারকে উত্তীর্ণ করে দেওয়ার, এককাল থেকে অন্যকালে নিয়ে যাওয়ার অখিল বিশ্বের সহৃদয় পাঠক কুলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নিরাপদ আশ্রয় ও উপায়—অর্থাৎ কালজয়ী অমরত্বের উপায়। যা ভয়াল জলধি বা তরঙ্গিনী স্রোতস্বিনীকে তরণ ও উত্তরণ করে, তা তরী বা তরণী। এ তরণী কাষ্ঠ নির্মিত নয়, নয় লৌহাদি মলিন বর্ণের অল্প মূল্যের ধাতু নির্মিত। অতি মূল্যবান, সকল মানুষের আদরণীয়, শোভন বর্ণে সমুজ্জ্বল সুবর্ণে নির্মিত এ তরী সোনার তরী। যেমন কাল নদী, তেমনি তার শক্তিধর নাবিক। যেমন নাবিক, তেমনি তার তরণী। সমগ্র বিশ্ব ভুবন কবির কাব্যকে স্থান দেয় হৃদয়ে পরম আদরে; কাব্য হয়ে থাকে অমর, কিন্তু সেই কবিব্যক্তিকে, তার অহংকে স্থান দেয় না। কবিও চান তাঁর কাব্য সাধনা লাভ করুক অবিনশ্বর মহিমা। যাঁর প্রেরণায় কবির কাব্য রচনা, সেই কবিজীবননিয়ামক কাল প্রবাহে তরীর নাবিককে কবি স্বেচ্ছায়, সাগ্রহে তাঁর যাবতীয় সাহিত্য সৃষ্টি কালজয়ী করার উদ্দেশ্য তুলে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ক্ষণকালের দুর্বলতায় কবি নিজেকেও কালপ্রবাহ বিজয়িনী তরণীতে চেয়েছিলেন তুলে দিতে, নিজ সৃষ্টির মতো নিজেকেও দিতে চেয়েছিলেন অমরতা। কিন্তু কবিকে স্থান দিলেন না নাবিক। কবিকে পড়ে থাকতে হল আপন কর্মক্ষেত্রে। একে কবি তাঁর সর্বস্ব, তাঁর প্রাণের ধন কাব্য সমাহারকে তুলে দিয়ে আপন সৃষ্টি থেকে বিচ্ছেদের বেদনা বোধ করেছেন, তার ওপর একলা কর্মক্ষেত্রে পড়ে থাকার এক নৈরাশ্য মিশ্রিত বিষাদ তাঁকে ঘিরে ফেলেছে। কবি বুঝতে পেরেছেন কাব্য সম্পদ এবং ব্যক্তিসত্ত্বা এক নয়; তাই তাকে পড়ে থাকতে হয়েছে তাঁর কর্মক্ষেত্রে; জীবন দেবতা চান তিনি আরও কিছু সৃষ্টি করুন তাঁর জীবন বৃত্তের সীমিত গণ্ডিতে।
কবি লিখলেন—“সংসার সমস্তই নেবে, একটি কণাও ফেলে দেবে না। কিন্তু যখন মানুষ বলে, ওই সঙ্গে আমাকেও নাও, আমাকেও রাখো, তখন সংসার বলে, তোমার জন্যে জায়গা কোথায়? প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু না কিছু দান করেছে; সংসার তার সমস্তই গ্রহণ করেছে, রক্ষা করেছে, কিছু নষ্ট হতে দিচ্ছে না—কিন্তু মানুষ যখন সেই সঙ্গে অহংকেই চিরন্তন করে রাখতে চাচ্ছে, তখন তার চেষ্টা বৃথা হচ্ছে।”
ক্ষুর ধরা খরপরশা ভরা নদীতে জীবন-দেবতা-নাবিকের বেয়ে আসা সোনার তরীকে দেখে একক বিচ্ছিন্ন বাধাবিঘ্ন সংকুল জীবনে সারস্বত সাধনা লব্ধ কাব্য ফলকে বিশ্বের বিদ্বজ্জন সভায় পৌঁছে দেওয়ার বাসনা যেমন জেগেছে, তেমনি জেগেছে কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে নিজেকে অমরত্ব দানের বাসনা। এই সোনার তরীকে কেন্দ্র করেই কবির উপলব্ধি ঘটেছে একটি পরম সত্যের–বিশ্ব সংসার কর্মফল গ্রহণ করে, গ্রহণ করে না অহংকে, ব্যক্তিকে। তাই কবিতাটির নামকরণের যথাসাধ্য বিষয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
সংস্কৃত সাহিত্যে প্রারম্ভিক শ্লোক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। আচার্য দন্ডী তাঁর কাব্যাদর্শ নামক নন্দন শাস্ত্র গ্রন্থে অভিমত দিয়েছেন কাব্যাদি প্রবন্ধ প্রারম্ভে আশীর্বাদ নমস্ক্রিয়া কিংবা বস্তু নির্দেশ থাকবে—“আশীৰ্নমষ্ক্রিয়া বস্তু নির্দেশো বাপি তন্মুখম্” (কাব্যাদর্শ ১।১৪)। রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’ প্রভৃতি কাব্যের প্রথম কবিতায় অর্থাৎ নাম ভূমিকার কবিতা সমগ্র কাব্যে বস্তু নির্দেশ বা মূল সুর বর্তমান।
‘সোনার তরী’ কাব্যে জীবন দেবতা প্রসঙ্গ সহ রবীন্দ্রনাথের গীতি কবি মানস, রোমান্টিক ভাবনা, চিত্র ধর্মিতা ইত্যাদি বিভিন্ন কবিতায় পরিস্ফুট হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য ‘সোনার তরী’ কবিতায় প্রাধান্য পাওয়ার জন্য কবিতাটির গুরুত্ব সমধিক।
‘সোনার তরী’ কবিতার মাঝির মতোই ‘মানবসুন্দরী’ কবিতায় ‘কর্ণধার’ ও ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র নাবিকরা রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়ামক জীবন দেবতা-রূপে বিভাবিত।
গীতি কবিতার সঙ্গে রোমান্টিসিজনের যোগ নিবিড়; গীতি কবিতার প্রধান বিষয় ব্যক্তিনিষ্ঠ ভাবনা হলেও প্রকৃতি প্রীতি, তীব্র ভাবনাভূতি, সৌন্দর্যাতুরতা ইত্যাদি রোমান্টিক লক্ষণ সমূহ গীতিকাব্য লক্ষণের সঙ্গে এক হয়ে থাকে। ‘সোনার তরী’ কবিতার ‘আমি’ কবি স্বয়ম্। তাই ব্যক্তিগত চিন্তা বা মন্ময় ভাবনার গীতিকাব্য ধর্মে ‘সোনার তরী’ অন্বিত হয়ে আছে। ফাল্গুনের বসন্ত ঋতুর রচিত সোনার তরী কবিতায় পরিমণ্ডপে শ্রাবণের বর্ষা ঋতুর ঘনঘটা চিত্রণ কবির প্রকৃতি প্রেমিকতার সঙ্গে কল্পনার দূরযান, সৌন্দর্যন্বেষণই সূচিত করে। শিলাইদহে বোটে বসে লেখা কবিতায় কবিনেত্রে পদ্মাপারের ছোটো গ্রাম, ছোটো খেত চাষিদের চষা জমি আসন্ন বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় তরীতে শস্য সম্ভার তুলে দিয়ে পারে নিয়ে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টার দৃশ্যবলি হয়ে ওঠে মোহময়। পদ্মা পরিমণ্ডলে এসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিরাকাঙ্ক্ষিত প্রকৃতিকে প্রাণ ভরে গ্রহণ করেছেন। সাধারণ মানুষের কাছাকাছি এসে রবীন্দ্রনাথ তৃপ্ত হয়েছেন; কিষাণদের গ্রাম, পদ্মা চরের ধান খেত, তরীতে ধান তুলে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদির বর্ণনায় কবি মানব মুখিতার পরিচয় রাখতে পেরেছেন। মর্ত্য ধরিত্রীর তুচ্ছ ক্ষুদ্র রূপ ও তার সন্তানদের প্রতি কবির এই যে ভালোবাসা, এ সবই তাঁর মর্ত্যা মমত্ব প্রকাশক।
‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘ঝুলন’ এবং ‘দুই পাখি’ প্রকৃতি কবিতায় subjectivity বা মন্ময়ভাবনা যে দৃঢ়ভাবে প্রকাশিত, সে কথা বলা বাহুল্য। আঘাত-সংঘাত, আলোড়ন-আন্দোলনে সুখাবেশবিবশ কবিব্যক্তিত্বের জাগরণ ‘ঝুলন’ কবিতায় যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি ফুটে উঠেছে ‘দুই পাখি’ কবিতার মুক্ত প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের প্রতি আবদ্ধ করে প্রাণের আকর্ষণ। ‘বসুন্ধরা’, ‘মানস সুন্দরী’, ‘সমুদ্রের প্রতি’ কবিতাবলিতে নদ-নদী জলধির বিচিত্র রূপ, পদ্মা তীরস্থ সাধারণ মানুষের বাসভূমি ও জীবনযাত্রা, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, মধ্যদিবস-মধ্যরাত্রি, বনবনানীর শ্যামলিমা, আকাশের নীলিমা, বাতাসের মুক্ত প্রবাহ, মাটির তুচ্ছ নগণ্য ধুলো বালি, ঘাসের গন্ধ ইত্যাদির প্রতি কবি প্রাণের গভীর মমত্ব প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব প্রকৃতির জন্য অসীম সৌন্দর্যের জন্য কবির আকাঙ্ক্ষা তীব্র ভাবানুভূতির মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘সোনার তরী’ কবিতায়। ‘পরশপাথর’ কবিতায় পৃথিবীর নগণ্যকে ফেলে দিয়ে স্পর্শমণি পরশপাথর খোঁজার ব্যর্থতা প্রকাশ করে। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় পিতার প্রতি ক্ষুদ্র বালিকার স্নেহাকর্ষণ প্রকাশ করে, ‘বৈষ্ণব কবিতা’য় দেবত্ব ও মানবত্বের সমতা প্রকাশ করে; রবীন্দ্রনাথ মর্ত্যভূমির জন্য তাঁর মমত্বের পরিচয় রেখেছেন। এ সবই রোমান্টিক কবি মানসের পরিচয়বাহী।
‘সোনার তরী’ কবিতায় একখানি ছোটো খেত ‘আমি একেলা’ প্রভৃতি পঙতিতে যে চিত্র ধর্মিতা আছে, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রায়’ ওই ‘যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে দিনের চিতা’ প্রভৃতি পঙতিতে, ‘বসুন্ধরা’য় ‘পদ্মার পশ্চিম পারে সুদূর আকাশে’ ইত্যাদিতে সেই একই চিত্র ধর্মিতা বর্তমান।
শ্রুতি-সুখদ ছন্দ ও শব্দাদির প্রয়োগে এবং পরিমিত আয়তনে ‘ঝুলন’, ‘পরশ পাথর’, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ প্রভৃতি কবিতা গীতি কাব্যত্বের গঠন-আঙ্গিকে প্রথম কবিতা ‘সোনার তরী’ সমধর্ম বিশিষ্ট।
‘সোনার তরী’ কবিতাতে কাব্যগত বিবিধ বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছে। তাই মনে করতে পারি কবিতাটির নামেই কাব্যটির নামকরণ।