বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে বিরাজমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি যেমন গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, তেমনি কাব্য কবিতা রচনাতেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তাঁর রচনাগুলিতে যেমন প্রকৃতি, মনস্তত্ত্ব ও বাস্তব জীবনের প্রভাব দেখা যায়, তেমনই রূপকথা বা কল্পনারাজ্যেরও প্রভাব বিদ্যমান। রূপকথার খোলা জানালা দিয়ে আমরা বিচিত্র কল্পলোকের পরিচয় লাভ করি। প্রতিভাবান সাহিত্যিকেরা এই রূপকথার জগৎ থেকেই কল্পনার উন্মেষের প্রতি উৎসাহিত হন। কবি রবীন্দ্রনাথও বাস্তবের মাটি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন দূর কল্পলোকে, অনির্দেশ্য রাজ্যে। ‘শিশু’, ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থের মতো আমাদের আলোচ্য ‘সোনার তরী’ও রূপকথার দেশের বর্ণনাময় কবিতা হয়ে উঠেছে।
‘সোনার তরী’র ‘নিদ্রিতা’ কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ রূপকথাকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। রাজপুত্র বা রাজকন্যার জীবন কাহিনির বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি মানবাত্মার প্রেমিক সত্তাটিকে অঙ্কন করেছেন। কবিতার শুরুতেই শিশুপাঠ্য কাহিনিতে মুখ ঢেকে থাকা রূপকথার গল্পকে তিনি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। একদিন ঘুমের ঘোরে কবি পৌঁছে যান রূপকথার স্বপ্নরাজ্যে। সেখানে তিনি যা দেখেছেন, তাই বর্ণনা করেছেন—
“সম্মুখে পড়ে দীর্ঘ রাজপথ,
দুধারে তারি দাঁড়ায় তরুসার,
নয়ন মেলি সুদূর পানে চেয়ে
আপন মনে ভাবিনু একবার—
অরুণ রাঙা আজ এ নিশি শেষে
ধরার মাঝে নূতন কোনো দেশে
দুগ্ধ ফেরাশয়ন করি আলা
স্বপ্ন দেখে ঘুমায় রাজবালা।”
তিনি শুধু নতুন দেশেই যাননি, সেখানে রাজবালাকেও দেখেছেন এবং ঘোড়ায় করে সমগ্র ঘুমের দেশে ঘুরেছেন। কিন্তু ‘কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী’। ঘুরতে ঘুরতে তিনি যখন রূপকথার দেশের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন, তখন দেখেন—
“ঘুমায় রাজা ঘুমায় রানি মাতা
কুমার সাথে ঘুমায় রাজ ভ্রাতা
একটি ঘরে রত্নদীপ জ্বালা
ঘুমোয় সেথা রয়েছে রাজবালা।”
কবি রূপকথার রাজকন্যাকে দেখে অভিভূত হন। তাঁর দুই বাহু দিয়ে তিনি ব্যাকুল হৃদয়ের কম্পন চাপতে চান, কিন্তু পারেন না। তাই তিনি—
“ভূতলে বসি আনত করি শির
মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন।”
তারপর তিনি নিদ্রিতা রাজকন্যার নিদ্রিত দুই আঁখির তারার পানে চেয়ে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে থাকেন। তবে তাঁর ভয়ও হয় ‘কী আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে’। শেষপর্যন্ত কবি কাজলের কালি দিয়ে ভূজপত্রে নিজের নাম ঠিকানা লিখে কনক সুতোয় গেঁথে রাজকন্যার রত্নহারে বেঁধে দেন। এমনিভাবে তাঁর রূপকথার দেশের অভিসার শেষ হয়। কিন্তু মনের অতৃপ্তি দূর না হওয়ায় তিনি ‘সুপ্তোখিতা’ কবিতাতেও ঘুমের দেশে অবস্থিত রূপকথার দেশের গল্প বর্ণনা করেছেন।
রূপকথার রাজ্যে গিয়ে তিনি দেখেন অশ্বশালায় ঘোড়া, হস্তীশালায় হাতি, মল্লশালায় রয়েছে মল্ল। যখন সকলের ঘুম ভাঙে, তখন—
“উঠিল জাগি রাজাধিরাজ, জাগিল রানি মাতা।
কচালি আঁখি কুমার সাথে জাগিল রাজভ্রাতা।”
রাজকন্যার ঘুম ভাঙার পর জিজ্ঞাসা করে ‘কে পরালে মালা?’ এরপর গলার মালা থেকে কাগজখানি খুলে—
“পড়িল নাম পড়িল ধাম পড়িল লিপি তার
কোলের পরে বিছায়ে দিয়ে পড়িল শতবার।”
এরপর রাজকন্যা বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত এবং বসন্ত—প্রত্যেক মাসেই স্বপ্নে দেখা প্রেমিকের কথা ভেবে যায়।
‘হিং টিং ছট’ কবিতাতেও রবীন্দ্রনাথ রাজার হরুচন্দ্রের রূপকথার রাজ্যে পৌঁছানোর বর্ণনা দিয়েছেন। তবে সেখানকার বর্ণনায় ‘নিদ্রিতা’ ও ‘সুপ্তোখিতা’ কবিতার মতো রোমান্টিকতা নেই, বরং রয়েছে হাস্যরস—
“স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবু চন্দ্রভূপ
অর্থ তার ভাবি ভাবি গবুচন্দ্ৰ চুপ ৷
শিয়রে বসিয়া যেন তিনটে বাঁদরে
উকুন বাছিতে ছিল পরম আদরে।”
এই কারণে রাজ্য খুব সমস্যায় পড়ে। সাধু, পণ্ডিতদের ডাক পড়ে। শেষে ‘যবন পণ্ডিতের গুরু মারা চ্যালা’—
“স্বপ্ন কথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া
কহিল গৌড়িয় সাধু প্রহর ধরিয়া
নিতান্ত সরল অর্থ অতি পরিষ্কার
বহু পুরাতন ভাব নব আবিষ্কার।”
‘সাধু সাধু সাধু’ ডাকে সব পরিষ্কার হয়ে যায়।
রূপকথার আশ্চর্য জগতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শৈশব থেকেই প্রবল আকর্ষণ ছিল। জন্মগতভাবে রোমান্টিক কবির স্বভাবে তাঁর রূপকথার প্রতি তীব্র টান ছিল। কারণ রূপকথায় তিনি মানুষের চিরকালের চাওয়া-পাওয়ার প্রতীকি তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছিলেন। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন—“রূপকথা নামটির চারিধারে একটি রহস্যময় ঘন মাধুর্য, একটি ঐন্দ্রজালিক মায়াঘোর বেষ্টন করে আছে। নামটি আমাদের হৃদয়ের গোপন কক্ষে গিয়ে আঘাত করে এবং সেখানকার সুপ্ত নামহীন বাসনাগুলির মধ্যে একটি সাড়া জাগিয়ে দেয়।”