Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

‘বসুন্ধরা’ কবিতার মর্মকথা কবিমনের কোনো বিচ্ছিন্ন অনুভূতি নয়, তার সঙ্গে রবীন্দ্রমানসের পূর্বাপর ভাবনাক্রমের যোগ আছে

রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্যধারা বিশ্লেষণ করলে তাঁর চিন্তা ও অনুভূতির একটি ধারাবাহিক ক্রমপরিণতির পথরেখা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর জীবন কাব্যধারাকে অবিচ্ছিন্ন বলে স্বীকার করেছিলেন। বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে হয়তো এক-একটি বিশেষ ভাব বা অনুভূতি তীব্র হয়ে প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু তাকে কখনোই প্রক্ষিপ্ত বা আকস্মিক বলা যাবে না। ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রীতি ও বিশ্বাত্মবোধের যে বাণীটি ফুটে উঠেছে তা আসলে সমগ্র রবীন্দ্র জীবনদর্শনেরই একটি অখণ্ড উপাদান। তাই রবীন্দ্র চিত্তাপ্রবাহের পূর্বাপরের সঙ্গে এই অনুভূতির যোগ সুস্পষ্ট।

রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রেম অঙ্কুরিত হয়েছে শৈশবকালেই, সেই ভৃত্যরাজকতন্ত্রের কাল থেকেই। তারপর সেই প্রকৃতিপ্রীতি একটি বিশিষ্ট রূপ লাভ করে ‘প্রভাতসংগীত’ পর্বে। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতা রচনার প্রাকলগ্নে সূর্যোদয় দেখে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি হয়েছিল এই প্রকৃতি ও মানবজীবনপ্রবাহ আনন্দময় ভঙ্গিতে কেবলই বহমান। ‘জীবনস্মৃতি’তে সেই বিশেষ অনুভূতির স্বীকারোক্তি আছে। এরপর ‘ছবি ও গান’, ‘কড়ি ও কোমল’ পর্বেও বিশ্বপ্রকৃতির ও মানবজীবন সংসারের লীলারস আস্বাদনের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আছে। ‘মানসী’ পর্বে সেই প্রকৃতিপ্রীতি ক্রমে তত্ত্বভাবে আক্রান্ত হয়েছে। ‘সোনার তরী’-তে প্রকৃতি ও মানবের মধ্যবর্তী সৌন্দর্যের এক বস্তুনিরপেক্ষ মূর্তি কল্পিত হয়েছে। কবি এক অনির্দেশ্য সৌন্দর্যের অভিসারী হয়েছেন।

তবু মনে রাখতে হবে এই ‘সোনার তরী’ পরেই রবীন্দ্রনাথ জমিদারী পরিদর্শনের সূত্রে প্রকৃতি ও মানবের সঙ্গে অনেক নিবিড়ভাবে যুক্ত হতে পেরেছেন। এই যুগটিই ‘ছিন্নপত্রে’র যুগ বলে রবীন্দ্রপাঠকের কাছে অধিক পরিচিত। ‘ছিন্নপত্র’র যুগেই বাংলার নদী-মাঠ-আকাশ-প্রভাত-সন্ধ্যা-শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার মধ্য দিয়ে প্রকৃতির বিচিত্র রূপ ও অনিঃশেষ সৌন্দর্য কবির দৃষ্টির সম্মুখে ক্রমাগত উন্মোচিত হয়েছে এবং জমিদারী কর্মসূত্রে বাংলার দরিদ্র বঞ্চিত সরল প্রজাদের জীবনধারার সঙ্গেও তিনি নিবিড় প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হয়েছেন। ‘ছিন্নপত্রে’ উচ্চারিত হয়েছে সেই বিস্মিত মন্তব্য—“কী বৃহৎ পৃথিবী! কী বিপুল মানব সংসার।”

‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘অহল্যার প্রতি’ কবিতাতেই কবি পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে প্রাণচৈতন্যের প্রবাহের কথা বলেছেন। পাষাণময়ী অহল্যার চেতনাপ্রাপ্তির সূত্রে কবি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছেন যুগ-যুগান্তসঞ্জিত বসুন্ধরার বাৎসল্যের স্বরূপ। বসুন্ধরার বুকে এই যে চৈতন্যের জন্ম-জন্মান্তর ব্যাপী অনুভব, তা অহল্যা পাষাণজীবনে কি অনুভব করেছিলেন—এ প্রশ্ন করেছেন কবি—

‘আছিলে বিলীন
বৃহৎ পৃথ্বীর সাথে হয়ে একদেহ,
তখন কি জেনেছিলে তার মহাস্নেহ?’

‘মানসী’র ‘অহল্যার প্রতি’ কবিতায় কবির যে অনুভূতি অহল্যার অনুভূতি বিষয়ক প্রশ্নরূপে উচ্চারিত, পরবর্তীকালে সেই অনুভূতিই কবির নিজস্ব হয়ে দেখা দিল ‘ছিন্নপত্রাবলী’ ও ‘সোনার তরী’-তে।

‘ছিন্নপত্রাবলী’তে শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখলেন বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তাঁর একাত্মবোধের অনুভূতির কথা—‘এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়েছিলুম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূরবিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধী উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত, আমি কত দূর দূরান্তর কত দেশ দেশান্তরের জল, স্থল, পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম…।’

ছিন্নপত্রাবলীতে এই অনুভবের কথা আরো আছে—এই পৃথিবীটি আমার অনেক দিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালোবাসার লোকের মতো আমার কাছে চিরকাল নূতন……। আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্বে যখন তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন, তখন আমি এই পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলুম।’

আমরা জানি, ‘বসুন্ধরা’ কবিতার রচনাকাল ২৬শে কার্তিক ১৩০০ বঙ্গাব্দ, ইংরাজি ১১ই নভেম্বর, ১৮৯৩। ‘মানসী’র ‘অহল্যার প্রতি’ কবিতাটির রচনাকাল প্রায় তিন বৎসর পূর্বে ১২৯৭ তে। ‘ছিন্নপত্রাবলী’র ৭০ সংখ্যক পত্রে যখন রবীন্দ্রনাথ ‘পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে থাকার কথা বলেন বা ৭৪ সংখ্যক পত্রে যখন পৃথিবীর সঙ্গে ‘অনেক জন্মকার ভালোবাসার কথা বলেন, তখনকার সময়টা যথাক্রমে ২০শে আগস্ট এবং ৯ই ডিসেম্বর ১৮৯২। অর্থাৎ ‘বসুন্ধরা’ কবিতা রচনার প্রায় বৎসরাধিক পূর্বে কথাগুলির প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে ‘ছিন্নপত্র’-তে। ‘বসুন্ধরা’র পূর্ববর্তী ‘সমুদ্রের প্রতি’ কবিতাতেও বিশ্বাত্মকতার অনুভূতি উচ্চারিত হতে শুনি। সর্বাপেক্ষা আশ্চর্যজনক, ‘সমুদ্রের প্রতি’ কবিতায় যেন ‘ছিন্নপত্রে’র হুবহু কাব্যানুবাদই পাঠক লাভ করেন—

‘মনে হয়, যেন মনে পড়ে
যখন বিলীনভাবে ছিনু ওই বিরাট জঠরে
অজাত ভুবনভৃণ মাঝে, লক্ষ কোটি বর্ষ ধরে
ওই তব অবিশ্রাম কলতান অন্তরে অন্তরে
মুদ্রিত হইয়া গেছে। সেই জন্ম-পূর্বের স্মরণ,
গর্ভস্থ পৃথিবী পরে সেই নিত্য জীবন স্পন্দন
তব মাতৃহৃদয়ের—অতি ক্ষীণ আভাসের মতো
জাগে যেন সমস্ত শিরায়, শুনি যবে নেত্র করি নত
বসি জনশূন্য তীরে ওই পুরাতন কলধ্বনি।’

অর্থাৎ ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় বিশ্বপ্রকৃতির বিচিত্রতায় ও মানবজীবনপ্রবাহের বহুমুখিতায় কবি যে নিজেকে নিঃশেষে মিশ্রিত করতে চান, বসুন্ধরার জন্মলগ্ন থেকে চেতনাপ্রবাহের মধ্যে কবির যে আত্ম আবিষ্কার, তা কোনো প্রক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক অনুভূতি নয়। সমগ্র রবীন্দ্রজীবন দর্শনের সঙ্গে এবং রবীন্দ্র-অনুভূতির ক্রমপরম্পরাতেই সেই অনুভূতি গ্রথিত ও আন্তরিক বলে স্বীকার করতে হবে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

শওকত আলী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

শওকত আলী (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ – ২৫ জানুয়ারি ২০১৮) বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্মের জন্য

Read More

লােকসাহিত্য কাকে বলে?

লােকের মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা, কাহিনী, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি হলাে লােকসাহিত্য হলাে। লোকসাহিত্য মূলত বাককেন্দ্রিক। কেবল মৌখিক নয়, ঐতিহ্যবাহীও, অর্থাৎ লোকপরম্পরায় লোকসাহিত্য মুখে মুখে

Read More

সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করো!

সাহিত্য: ‘সাহিত্য’ শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে এসেছে। এখানে সহিত শব্দের অর্থ- হিত সহকারে বা মঙ্গলজনক অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পর্কে বলেন, “একের সহিত অন্যের মিলনের মাধ্যমই হলো

Read More

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.