Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার চমৎকার নিসর্গ-প্রীতির বর্ণনা দাও

‘সোনার তরী’ কাব্যে প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি কবির ভালোবাসা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। এ কাব্যে প্রকৃতি-বিষয়ক কবিতা যেমন আছে, মানুষ সম্পর্কিত কবিতারও তেমনি অভাব নেই। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি মানবপ্রেম দিয়ে শুরু হলেও মানবসংসার অতিক্রম করে প্রকৃতির মধ্য দিয়ে সে প্রেম প্রসারিত হয়েছে বিশ্বজগতের দিকে।

শিশুকন্যার কাছে বিদায় নিয়ে বেদনাভারাক্রান্ত হৃদয়ে কবি যাত্রা করলেন তাঁর গন্তব্যস্থলের দিকে। চলতে চলতে পথের দু’ধারে শস্যভারে আনত স্যক্ষেত্রগুলো দেখে তাঁর যেন তারা শরতের রৌদ্র পোহাচ্ছে। পথের ধারে বৃক্ষশ্রেণী যেন উদাসীনের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে, শরতের ভরাগঙ্গা খরবেগে বয়ে চলেছে। এখানে শরৎকালের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সুন্দর ও যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু যেটা লক্ষ্য করবার বিষয় তা এই যে, শরৎ প্রকৃতির নির্মল, উদার, উৎসাহব্যঞ্জক প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য কবিকে আকর্ষণ করলেও তিনি তার মধ্যে যেন একটা বেদনার সুর অনুভব করেছেন। শিশুকন্যার নিষেধের বাণী অন্তরে ধ্বনিত হয়ে কবির ভারাক্রান্ত হৃদয়ের আবেগ যেন প্রকৃতিতেও সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে। তাই তাঁর তরুশ্রেণীকে উদাসীন মনে হয়, দিগন্তবিস্তৃত ধরণীকে ক্লাস্ত বলে মনে হয়।

রৌদ্রালোকিত শরতের শস্যক্ষেত্রের বর্ণনায় যে শান্ত পরিপূর্ণতার চিত্রটি ফুটে উঠেছে এবং শরতের আকাশের শুভ্র স্থির মেঘের বর্ণনায় যে বাস্তব জীবনের পরিচিত দৃশ্যের উপমাটি ব্যবহৃত হয়েছে তা নিসর্গ-বর্ণনা দু’টিকে অপূর্ব কাব্যসৌন্দর্যে মণ্ডিত করেছে। দুই বর্ণনাই চিত্রময় এবং শান্ত প্রকৃতির চিত্রায়নে বর্ণময়। কবি কল্পনা করেছেন, শরতের আকাশে ভাসমান সাদা মেঘের খণ্ডগুলো সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মত আকাশে স্থির হয়ে আছে। এই উপমাটির প্রয়োগে শরৎপ্রকৃতির মূল বৈশিষ্ট্যটি যেমন চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে, তেমনি বাস্তব গার্হস্থ্যজীবন থেকে উপমা সংগ্রহ করায় পার্থিব জীবনের প্রতি কবির গভীর আকর্ষণও সূচিত হয়েছে।

‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় পূজার ছুটির শেষে স্ত্রী-কন্যার নিকট হতে গৃহস্বামীর বিদায়গ্রহণের যে করুণ ছবিটি পাওয়া যায় নিজের ভাষায় তা পরিস্ফুট করো।

পূজার ছুটির শেষে আজ কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার দিন। শরতের দ্বিপ্রহরে গ্রামবাসী সকলে বিশ্রামে রত, কিন্তু এই গৃহস্বামীর ঘরে বিশ্রামের অবকাশ নেই। প্রবাসযাত্রী গৃহস্বামীর জিনিসপত্র গুছিয়ে দেবার জন্য সকলে ব্যস্ত। বিচ্ছেদের বেদনায় গৃহিণীর চিত্ত ভেঙে পড়েছে, কিন্তু কাঁদবার সময় নেই। ছোট বড়, খুঁটিনাটি অজস্র প্রয়োজনীয় সামগ্রী তিনি স্বামীর জন্যে সাজিয়ে দিয়েছেন। বোঝা পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠেছে, কিন্তু গৃহস্বামীর কিছুই ফেলে যাওয়ার উপায় নেই। প্রতিটি দ্রব্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বামীগতপ্রাণা নারীর উৎসর্গিত ভালোবাসা। গৃহস্বামী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলেন, তারপর ফিরে তাকালেন গৃহিণীর দিকে। ধীরে ধীরে বললেন ‘তবে আসি’। অমনি মুখখানি ফিরিয়ে মাথা নিচু করে চোখের ওপর আঁচল চাপা দিয়ে উদ্‌গত অমঙ্গলের অশ্রু গোপন করলেন গৃহিণী।

বাইরে দ্বারের কাছে বসে ছিল গৃহস্বামীর চার বছরের শিশুকন্যা। অন্যদিন এমন সময়ে স্নানাহারের পর সে নিদ্রিত হয়ে পড়ত। আজ তার মা তাকে দেখতে পারেননি বলে এত বেলা হয়ে যাওয়াতেও স্নানাহার তার এখনও কিছুই হয়নি। এতক্ষণ সে পিতার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মত ঘুরছিল, নীরবে দেখছিল বিদায়ের আয়োজন। এখন শ্রান্তদেহে কি মনে করে যেন সে চুপচাপ দ্বারপ্রান্তে বসে ছিল। পিতা তার কাছে এসে ‘মাগো আসি’ বলে বিদায় চাইতে বিষণ্ণ নয়নদুটি তুলে দৃঢ়স্বরে বলল, ‘যেতে আমি দিব না তোমায়’। পিতাকে কোনো বাধা সে দিল না, যেখানে ছিল সেখানেই রইল, শুধু নিজের হৃদয়ের স্নেহের অধিকার ঘোষণা করে উচ্চারণ করল, ‘যেতে আমি দিব না তোমায়।’ কিন্তু যাত্রার সময় হয়ে এল, গৃহস্বামীকে যাত্রা করতে হল স্ত্রী ও কন্যাকে রেখে।

বাঙালি জীবনের এক অতি বাস্তব চিত্রই কবির বর্ণনায় করুণরসে পাঠকের চিত্তকে অভিভূত করে।

‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি ‘মরণপীড়িত সেই চিরজীবী প্রেম’-এর অসম সংগ্রামে করুণ পরিণতির বিষাদময়তায় পূর্ণ।—আলোচনা করো।

সাধারণ গৃহস্থ পরিবারের একটি করুণ বিদায়ের দৃশ্যের বর্ণনা থেকে কবির কল্পনা উত্তীর্ণ হয়েছে এক সার্বভৌম জীবনসত্যের উপলব্ধিতে। একদিকে প্রেমের দুর্জয় শক্তি, প্রেমের অধিকারবোধ, অন্যদিকে মৃত্যুর অনিবার্যতা। বিশ্বে এই দুই শক্তির মধ্যে অহরহ দ্বন্দ্ব চলেছে। কিন্তু এ সংগ্রাম অসম সংগ্রাম। কারণ প্রেমের শক্তি যত প্রবলই হোক, শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর শাসন তাকে মেনে নিতেই হয়। জীবনপ্রবাহ অনিবার্যভাবে চলেছে মরণের অভিমুখে। তা জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রেমও চিরজীবী হতে পারে না। কবি প্রেমে বলেছেন ‘মরণপীড়িত’ এবং তা চিরজীবীও। জীবন যেমন মৃত্যুর মতই সত্য, তেমনি জীবনের অঙ্গীভূত প্রেমও সত্য। বিশ্বে কোনো বন্ধন চিরস্থায়ী হতে পারে না জেনেও মানুষ তার প্রিয়জনকে চিরকালের জন্য হৃদয়বন্ধনে বেঁধে রাখতে চায়। মৃত্যু আছে জেনেও এ আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত হয় না। একদিকে নিরন্তর ভালোবাসার বন্ধনগুলি রচিত হচ্ছে, অন্যদিকে বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। প্রেম তার সমস্ত শক্তি দিয়েও ভালোবাসার ধন শক্তিকে রক্ষা করতে পারে না; এখানেই তার অসম্পূর্ণতা। এইজন্যে বিশ্বে বেদনা জেগে উঠেছে। প্রেমের করুণ অবসান যে বিষাদ জাগায় তা চোখের ওপরে সঞ্চারিত অশ্রুবাষ্পের মত বিশ্বসংসারকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

প্রেমের করুণ আর্তিতে পরিপূর্ণ এ বিশ্ব-সংসার কবির দৃষ্টিতে বিষাদময়ীরূপে প্রতিভাত হয়েছে। প্রেমের আত্ম-ঘোষণায় যে দীপ্তি প্রকাশ পায় তার সৌন্দর্য ও মহিমা আশ্চর্য সন্দেহ নেই, কিন্তু মৃত্যুর অন্ধকার তাকেও গ্রাস করে। প্রেমের প্রবল অধিকার বোধ আর মৃত্যুর অনিবার্যতা—এই শক্তির দ্বন্দ্ব চলেছে অহরহ। এই অসম দ্বন্দ্বে প্রেমের নশ্বরতাই প্রতিপন্ন হচ্ছে। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি প্রেমের পরাজয়ের কারুণ্যে বিষাদময়।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান ও অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। গবেষণার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা এবং মানুষের

Read More
গবেষণা পদ্ধতি কাকে বলে? গবেষণা পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য, গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল, গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি

গবেষণা পদ্ধতি কাকে বলে? গবেষণা পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য, গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল, গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি

গবেষক যখন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটি সুশৃঙ্খল কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে, তখন তাকে গবেষণা পদ্ধতি বলে। গবেষণা কোনো বিক্ষিপ্ত ও

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.