কাব্যের প্রথম কবিতার নাম ‘সোনার তরী’ এবং সমগ্র কাব্যগ্রন্থটির নামও তাই। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থে প্রধান ভাবপ্রকাশ কবিতার নাম অনুসারে নামকরণের রীতি দেখা যায়, যেমন ‘চিত্রা’, ‘বলাকা’ প্রভৃতি কাব্যে। ‘সোনার তরী’ কবিতার মাধ্যমে এ কাব্যের মূল কথাটি প্রকাশিত হয়েছে, এজন্য কাব্যগ্রন্থের একই নাম।
এ কাব্যের আরও দুটি প্রধান কবিতা হলো ‘মানসসুন্দরী’ এবং ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’। ‘মানসসুন্দরী’ কবিতায় কবি বলেছেন:
“কোন বিশ্বপার
আছে তব জন্মভূমি? সংগীত তোমার
কতদূর নিয়ে যাবে কোন কল্পলোকে
আমারে করিবে বন্দী গানের পুলকে
বিমুগ্ধ কুরঙ্গসম? এই যে বেদনা
এর কোন ভাষা আছে? এই যে বাসনা,
এর কোন তৃপ্তি আছে? এই যে উদার
সমুদ্রের মাঝখানে হয়ে কর্ণধার
ভাসায়েছ সুন্দর তরণী, দশ দিশি
অস্ফুট কল্লোলধ্বনি চির দিবানিশি
কী কথা বলিছে কিছু নারি বুঝিবারে,
এর কোন কূল আছে?”
‘সোনার তরী’, ‘মানসসুন্দরী’ এবং ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’—এই তিনটি কবিতাতেই সংশয়ের ভাব স্পষ্ট। কবির সৃষ্টির যে ফল, তা সোনার ধানের মতোই মানবজীবনের অপরিহার্য। তবে সোনার তরীর নাবিক নৌকা বোঝাই করে নিলেও, কবির নিজে সেই তরীতে কোনো জায়গা হয় না।
‘মানসসুন্দরী’তে কাব্যফসলের কথা নেই, বরং কবি নিজের কথাই বলেছেন। তাঁর জীবনের অধিষ্ঠাত্রী মানসসুন্দরী কবিকে নিয়ে সমুদ্রে তরী ভাসিয়েছে। এই যাত্রার শেষে কোথাও কি চরিতার্থতার, সাফল্যের তীর্থ অপেক্ষা করছে? হয়তো আছে, কারণ কবি মানসসুন্দরীর ‘অভয় আশ্বাস ভরা’ বিশাল নয়ন দেখে আশ্বাস পান। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’তেও ‘সোনার তরী’র হাল যার হাতে, সে কিছু না বললেও ইঙ্গিতে তার কাছ থেকে যেন ভরসা পাওয়া যায়। এই বারবার যাত্রা, তরী বেয়ে যাওয়া এবং কর্ণধারের উল্লেখের একটি রূপকার্থ আছে।
‘সোনার তরী’ কবির কাব্যফসল তুলে নেয় এবং কবিকেও বহন করে। প্রথম কবিতায় তরী কবির ব্যক্তিজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সকলের কাছে বহন করে নিয়ে যায়। কবির কীর্তিগুলি বিশ্বের কাছে পৌঁছায়। তবে ব্যক্তিটি বিশ্বের কাছে প্রয়োজনীয় নয়, বরং ব্যক্তির সাধনার ফলই বিশ্বের জন্য নিবেদন করা যায়। ‘সোনার তরী’ এ দৌত্য কাজে নিযুক্ত, কিন্তু ‘মানসসুন্দরী’ বা ‘নিরুদ্দেশ যাত্রায়’ তরীর ব্যবহার অনুরূপ। তরীর আরোহী কবিকে মানসসুন্দরী বা রহস্যময়ী নারী কল্পনার নতুন থেকে নতুনতর জগতে নিয়ে চলেছে।
এ যাত্রার মূল আকাঙ্ক্ষা হলো এক সফলতা থেকে ভিন্নতর সফলতায় পৌঁছানো। ‘সোনার তরী’র রূপকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কবি বলতে পারেন, এই কাব্যগ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুচ্ছ তাঁর বহু সাধনার ফসল। কবি সেই ফসল তুলেছিলেন সোনার তরীতে, বিশ্বজনের চিত্তের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছেন।
কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনকে বাদ দিয়ে কবি সাধনালব্ধ ধনকেই নিবেদন করেছেন। আবার অন্য অর্থে, কবির মানসসুন্দরী বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাঁকে অজানার উদ্দেশ্যে নিয়ে চলেছেন। এই কাব্যই শেষ নয়, ভিন্নতর সাধনা এবং সিদ্ধির জন্য তাঁর অপেক্ষা রয়েছে। সেই সাধনার ভিতর কবির চলেছে নিরন্তর যাত্রা। তাই যাত্রার প্রেক্ষিতে কবির কাব্যের ‘সোনার তরী’ নামকরণ সম্পূর্ণ সঙ্গত।