‘সোনার তরী’ কাব্যের কবিতাগুলি রচনার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পল্লীজীবনের কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন। তিনি পদ্মানদীর জলরাশিতে দিনের পর দিন ভাসতে ভাসতে প্রকৃতির মনোরম দৃশ্যের মধ্যে প্রবাহিত হতেন। পদ্মার তটভূমিতে গ্রীষ্মের সবুজের সমারোহ এবং সাধারণ গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার প্রবাহ তাঁকে পার্থিব জীবনের প্রতি এক অন্তহীন আকর্ষণ জাগিয়ে তুলেছিল। কবি সেই জীবন ও প্রকৃতির অদৃশ্য রহস্যকে বোঝার চেষ্টা করেছেন।
রবীন্দ্র-সমালোচকরা একমত যে পদ্মাতীরের পল্লীপ্রকৃতি ও পল্লীজীবনের গভীর যোগাযোগের ফলে তিনি মর্ত্য-পৃথিবী এবং মানবজীবনের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ ও গভীর প্রেম অনুভব করেছেন। এই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ‘সোনার তরী’ কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় ধরা পড়েছে। বিশেষ করে ‘দরিদ্রা’, ‘যেতে নাহি দিব’, ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘বসুন্ধরা’ প্রভৃতি কবিতায় তাঁর মর্ত্যপ্রেম ও মানবপ্রীতির অনুভূতি সুস্পষ্ট।
‘বৈষ্ণবকবিতা’ নামক কবিতায়ও তাঁর মানবপ্রেম ও মর্ত্যপ্রেমের মূল ধারণাটি প্রবাহিত হয়েছে, যা ‘সোনার তরী’ কাব্যের প্রধান উপলব্ধি হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণব পদাবলীতে বৈষ্ণব তত্ত্বের চিত্রায়ণ ঘটেছে, যেখানে পরমাত্মা এবং জীবাত্মার চিরন্তন লীলাই মূল বিষয়। এই কারণেই বৈষ্ণব তত্ত্বজ্ঞরা ঘোষণা করেছিলেন যে, বৈষ্ণব পদাবলীর রস-সম্ভোগ অনভিজ্ঞদের জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, বৈষ্ণব কবিতা পাঠক বা শ্রোতাকে মুগ্ধ করে, কারণ এখানে দেবতার প্রেমের লীলার বিবরণ নয়, বরং মানবীয় প্রেমই দেব-দেবীর প্রেমের আচ্ছাদনে আবৃত হয়ে পরিবেশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের মতে, যে আনন্দ সারা জগতের মূল, সেটি মানবীয় প্রেমের মাধ্যমে ক্ষণিক ও আংশিক উপলব্ধি হয়। বাস্তব প্রেমের মধ্যেই দেবত্ব নিহিত রয়েছে। কবির এই উপলব্ধি ‘বৈষ্ণব কবিতা’য় প্রকাশিত হয়েছে। তাই তিনি বৈষ্ণব কবিকে প্রশ্ন করেন:
“সত্য করে কহো মোরে হে বৈষ্ণবকবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমগান
বিরহ-তাপিত।”
এই প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, এই মৃন্ময় ধরিত্রীর কোনো প্রেমিকা মানবীর প্রেমই বৈষ্ণব কবির আদর্শ। শ্রীরাধিকার প্রেমের মহিমা বর্ণনার গভীরতা বৃদ্ধি করে। বৈষ্ণব কবি এই প্রশ্নের মাধ্যমে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে প্রেমের চিত্র রাধাকৃষ্ণের প্রেমের বর্ণনায় ফুটে ওঠে, আসলে তা পার্থিব জীবনে নরনারীর প্রেমলীলা থেকেই সংগৃহীত।
‘বৈষ্ণবকবিতা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে যে, ব্যক্তিজীবনের প্রেমের অভিজ্ঞতাই বৈষ্ণব কবিদের রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁরা লৌকিক প্রেমকেই লোকাতীত প্রেমে পরিণত করেছেন। বাস্তব জীবনের সকল মানবীয় সম্পর্কের মধ্যে যে প্রীতি ও ভালোবাসা প্রকাশিত হয়, তাকেই বৈষ্ণবরা ঈশ্বরপ্রেমে রূপান্তরিত করেছেন। দেবতা তাঁদের কাছে প্রিয়জনের সম্পর্কের মধ্যে অনুভূত হয়েছে, আর প্রিয়জনও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে দেবত্বে:
“দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
প্রিয়জনে–প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই
তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা!
দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।”