পত্রটির উৎসসূত্র বাল্মীকি রামায়ণ। পিতৃসত্য পালনের জন্য পঞ্চবটী অরণ্যে নির্বাসিত বনবাসী লক্ষ্মণের যৌবন-কান্তিতে মুগ্ধ হয়ে লঙ্কাধিপতি রাবণের ভগিনী শূর্পনখা তার প্রেমে পড়ে। আর তার প্রেম নিবেদনের উদ্দেশ্যেই দশরকন্দন রামানুজ লক্ষ্মণকে এই পত্রটি লিখেছে। মোট ৭টি স্তবক পত্রটি সমাপ্ত হয়েছে। পত্রিকাটি একটি কুমারী হৃদয়ের প্রণয়জনিত রোমান্টিক ভাবোচ্ছ্বাসে ভরা।
বনবাসী লক্ষ্মণের পরিচয় শূর্পনখা জানত না। তাই পত্রিকার সূচনাই হয়েছে তার সবিশেষ পরিচয় জানবার কৌতূহলে। প্রশ্নবাক্য দিয়ে পত্রটি শুরু হয়েছে যা তাকে প্রথম থেকেই চমৎকার নাটকীয়তা দান করেছে।
‘কে তুমি, বিজন বনে একাকী;
বিভূতিভূষিত অঙ্গ? কি কৌতুক কহ,
বৈশ্বানর, লুকাইছ ভস্মের রে?
মেঘের আড়ালে যেন পূর্ণশশী আজি?’
প্রথম স্তবকে দেখি দুটি প্রশ্নবাচক সর্বনাম ‘কে’ ও ‘কি’। এর ব্যবহার। দ্বিতীয় চরণে ‘কি কৌতুক কই’ অংশটি ‘ক’-এর অনুপ্রাস ঘটায় সুন্দর শ্রুতিমাধুর্য সৃষ্টি হয়েছে। আর শুরুতেই কবি লক্ষ্মণের অপূর্ব রূপলাবণ্যের উৎকর্ষ বোঝাতে এনেছেন, চমৎকার উপমা—‘মেঘের আড়াল যেন পূর্ণশশী আজি?’
দ্বিতীয় স্তবক থেকে অজ্ঞাত পরিচয় অরণ্যবাসী লক্ষ্মণকে কেন্দ্র করে শূর্পনখার হৃদয়ের প্রেমোচ্ছ্বাসের পরিপূর্ণ উন্মীলন ঘটেছে। সে নিজের সমস্ত প্রণয়বাসনাকে অবারিতভাবে উন্মোচন করেছে এই পত্রে। তাঁর মনে অচেনা এই পুরুষকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে একের পর এক প্রশ্ন, চতুর্থ স্তবক পর্যন্ত এর ক্রমবিকাশ ঘটেছে।
পঞ্চম স্তবকে হঠাৎ কিছু বিপরীত সুর শূর্পনখার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। চতুর্থ স্তবক পর্যন্ত যে রাজকীয় বৈভবের জীবনযাপনের বর্ণনা শূর্পনখার কণ্ঠে শোনা গেছিল তা এই স্তবকে এসে বাঁক পরিবর্তন করে। রাজপরিবারের কন্যা হওয়ায় জীবনে কখনো তাকে কৃষ্ণসাধন করতে হয়নি। কিন্তু অরণ্যবাসী সন্ন্যাসীবেশধারী লক্ষ্মণের প্রতি তার প্রেমনিষ্ঠা এতটাই প্রবল যে মুহূর্তেই সে নিজেকে তার প্রেমাস্পদের মতো একই দুঃখ বরণের জন্য প্রস্তুত করে নিতে পারে। তাই তাকে বলতে শুনি—
‘এ বেশ ভূষণ ত্যজি উদাসিনী বেশে
সাজি, পূজি, উদাসীন, পদ-পদ্ম তব!’
অর্থাৎ অরণ্য জীবন ও রাজপরিবারের ঐশ্বর্য-প্রাচূর্যপূর্ণ জীবনের মধ্যে যে ভেদারেখা তা সে এভাবেই মুছে দিয়ে নিজেকে প্রেমাস্পদের সঙ্গে একই আসনে অধিষ্ঠিত করতে চেয়েছে।
ষষ্ঠ স্তবকেও এসে এই প্রথম আমরা শূর্পনখাকে নিজ পরিচয় দিতে দেখলাম, এতক্ষণ সে নিজের নাম ও আত্মপরিচয় গোপন করে রেখেছিল।
পত্রটির সপ্তম স্তবকটি একটু ভিন্ন প্রকৃতির। শূর্পনখা এই পত্রটি একই কালপর্বে লেখেনি, তার উল্লেখ আছে এই পর্বে।
“এত দূর লিখি/লেখন, সখীর মুখে শুনিনু হরষে/….., রাজরথী দশরথ অযোধ্যাপতি,/পুত্র তুমি, পুত্র তুমি, হে কন্দর্প গর্ব্ব-খর্ব্ব করি, তাঁহার,” এই উক্তি থেকেই বোঝা যায়, কিছুদূর পত্র লেখবার পর একটি ছেদ পড়েছে। তারপর আবার পত্র লেখা শুরু করেছে শূর্পনখা। সুতরাং, এই একটি পঙ্ক্তির মধ্যে দিয়ে পত্ররচনার ভিন্ন ভিন্ন কালপর্বের ইঙ্গিত কবি দিয়েছেন।
তাছাড়া, সখীমুখে সে লক্ষ্মণের পরিচয় জেনেছে অনেক পরে, তাই পত্রের প্রথমে সন্ন্যাসী বেশধারী সুন্দর যুবক লক্ষ্মণ সম্বন্ধে তার যা যা প্রশ্ন, কৌতূহল সবই স্বাভাবিকতা হয়েছে।
ওভিদের লেখা ‘Heroides’ কাব্যের সপ্তম পত্রের সঙ্গে এই পত্রিকার বিষয়গত সাদৃশ্য রয়েছে। ওভিদের রচনায় রাজা সিকাত্তশের বিধবা পত্নী রাণী ডিডো ভিন্নদেশী বিপন্ন রাজকুমার ‘ইনিসে’র প্রেমে পড়ে এরূপ প্রেমাকুল অভিব্যক্তিতে তাঁর প্রেমপত্রটি লিখেছিলেন। মধুসূদন রচিত শূর্পনখা-র পত্রিকাতেও এই একই রকম রোমান্টিকতা চোখে পড়ে। তাছাড়া, রামায়ণ থেকে আমরা জেনেছি শূর্পনখাও ছিলেন এক বিধবা, যার স্বামী ছিলেন কালকের বংশের রাক্ষস-রাজ বিদ্যুৎজিহ, যিনি যুদ্ধের সময় ভুলক্রমে রাবণের হাতে নিহত হয়েছিলেন। এজন্য রাবণ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ বিধবা ভগিনীর যথাসম্ভব মানসিক সুখ শান্তি উৎপাদনের জন্য দণ্ডকারণ্যে শূর্পনখার যথেচ্ছ ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন, আর তখনই তার সামনে আবির্ভূত হয় বনচারী ভিনদেশী রাজকুমার লক্ষ্মণ। আর তাকে দেখেই তার রূপমুগ্ধ হয়ে পড়েন শূর্পনখা। রামায়ণের এই কাহিনি মধুসুদনের হাতে এসে নতুন রূপ পেয়েছে। রামায়ণের কাহিনির প্রথমভাগটুকু বর্জন করেছেন মাইকেল, তার স্বামী প্রসঙ্গের উল্লেখ এ পত্রে পাই না, সে নিতান্তই কুমারী রাজকন্যা, এবং পত্রের শুরুতেই তার সম্পর্কে প্রচলিত কুৎসিত ধারণা থেকে পাঠককে মুক্ত থাকতে বলেছেন কবি। এ আদেশ সচেতন ভাবেই কবি করেছেন, তাতে পত্রটিকে এক রোমান্টিক প্রণয়পত্রের মর্যাদা দানে বিশেষ সুবিধাই হয়েছে।
এই পত্রকাব্যটি মূলত বর্ণনাধর্মী, এতে অন্যান্য পত্রের মতো খুব বেশি নাটকীয়তা নেই, প্রেমপত্রের যে স্বাভাবিক সহজ সরল আবেদন তা এই পত্রটিতে আগাগোড়াই রক্ষিত হয়েছে। এ চিঠিতে জটিলতা, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের অবকাশ কম, তাই তা সহজেই পাঠক হৃদয়কে স্পর্শ করে!
নাটকীয়তা স্বল্প পরিমাণে থাকলেও এ কাব্যের সংলাপে কোথাও কোথাও নাটকীয়তা আনয়নের জন্য সম্বোধন সূচক বাক্যের ব্যবহার রয়েছে।
‘হে তেজস্বি, শীঘ্ৰ আসি কহ মোরে শুনি’