পত্রিকাটির সূচনাতেই দেখা যায়, সম্বোধন নিয়ে লেখিকার সংকোচের কারণ হল, প্রণয় বিষয়ে পারস্পরিক সম্পর্কের বিরোধিতা। দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী হয়ে তারা প্রণয় ভিক্ষা করছেন বৃহস্পতির শিষ্য সোমের কাছে। সমাজ ও ধর্মের দৃষ্টিতে উভয়ের প্রেম অবৈধ ও নিন্দিত। কিন্তু হৃদয়াবেগ ও কাম প্রবৃত্তি এতই প্রবল যে গুরুপত্নী নিজেকে সংযত রাখতে পারছেন না। অপরাধ জেনেও তিনি কামনার প্রবল ভাবোচ্ছ্বাসে ভেসে চলেছেন। চিঠির ভাষাতেও এই অসংযত কামনার গাঢ় রং ফুটে উঠেছে।
‘সুধাংশু সিধি, আমি গুরুপত্নী! তুমি পুরুষরত্ন! কী কপাল, সম্পর্কের কথা ভুলে গিয়ে ইচ্ছে করছে তোমার পদসেবা করতে। খুবই লজ্জার কথা! পাপের কথা। জাতের এই পোড়া লেখনী একথা লিখছে কেমন করে তা ভাবলে শিহরিত হতে হয়। কিন্তু দোষটা কলমের ঘাড়ে চাপিয়ে কী লাভ! বৃথা তাকে গঞ্জনা দেওয়া। মনের কথা লেখে কলম। মন পুড়লে কলমের কী দোষ! সেও পুড়বেই। গাছের মাথায় বাজ পড়লে কেবল গাছ পোড়ে না, দগ্ধ হয়ে যায় তার পদাশ্রিত লতাও। এইভাবেই চন্দ্রের প্রতি তাঁর খেদোক্তি প্রকাশ করতে থাকে।
কুকর্মে লিপ্ত দুর্বৃত্ত যেমন প্রথমেই নিভিয়ে দিতে চায় আলো, তেমনি স্মৃতিকে আঁধারে ঢেকে দিতে চায় ‘পাপিনী’ তারা। অতীত ভবিষ্যৎ সবই ধীরে ধীরে বিস্তৃত হতে চায়। ভুলে যেতে চায়, কে সে? কুল, মান, ধর্ম, লজ্জা, ভয়, সকল আজ তার কাছে তুচ্ছ, ফুলের খাঁচা ভেঙে কুল বিহঙ্গিনী বায়ুপথে উড়ে চলেছে। তারা অনুরোধ করেছে, ‘তারানাথ’ সোম এসে তাকে গ্রহণ করুন। ‘ধর আসি তারে তারানাথ’। পদ্ম ফুলের বুকের গভীরে যেমন লুকিয়ে থাকে ‘সৌরভ’, তেমনি তারার হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে ছিল সোমের জন্য ভালোবাসা। জ্বলন্ত আগুনকে যেমন গোপন করা যায় না, তেমনি ওই ভালোবাসাকে গোপন রাখা গেল না। নীলধ্বজ কন্দপ যেভাবে তার ‘পঞ্চঘর শর’ হেনে অসহায় পুরীকে জিতেছে, সেইভাবে তারাকে জিতে নিয়েছে পুষ্পধনু।
এখন সোম ছাড়া কে তাকে বাঁচাবে? তাই, ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রিকাটিকে রোমান্টিক প্রেমের আলেখ্য হিসাবে বিচার করলে দেখা যায়–সংকোচ ও লজ্জার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়ে এটি সত্যিই একটি সুন্দর কবিতা হয়ে উঠেছে, ‘Dramatic Monologue’-এর অবসর নেওয়ায় এর ভেতর দিয়ে আশ্চর্য এক নারী কণ্ঠ শোনা যায়। এ নারী দ্বিধা ও সংশয়ে জর্জরিত হলেও, এ নারীর মধ্যে ভালোবাসার উদ্বেল উষ্মতার অনুভব করা যায়। এ পত্রিকার ‘তারা’ যেন রক্তমাংসের একটি জীবন্ত চরিত্র। সমাজের বাঁধন কেটে সে তার প্রেমকে অবলম্বন করেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছে। সাহিত্য যদি জীবনের সমালোচনা হয়, এই পত্রিকাটিতে তার সুস্পষ্ট পরিচয় রয়েছে। জীবনের কথা এমন নির্মমভাবে আমাদের সাহিত্যে খুব কমই বলা হয়েছে। শত ধিক্কার সহ্য করেও তারা ভারত প্রেমকে ত্যাগ করতে পারেনি। এছাড়া শব্দের যথাযথ ব্যবহার, উপমা অলঙ্কারের প্রয়োগ এবং নাটকীয় ভঙ্গি এই পত্রিকাটিকে ‘বীরঙ্গনা’ কাব্যের শ্রেষ্ঠ একটি পত্রিকায় পরিণত করেছে।