Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Ode এবং Lyric-এর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করো! বীরাঙ্গনা কাব্যে এ দুটির মধ্যে কোনটির প্রাধান্য দেখা যায়?

কবির ব্যক্তিগত জীবনবোধ, উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতার প্রকাশে যেমন কবিতা রচিত হয়, তেমনি আরেকটি কাব্য রচনার ধারা লক্ষ্য করা যায়। সেই ধারা মুগ্ধ বর্ণনাত্মক। কবির নিজস্ব জীবনবোধ ছাড়াও যে সব সত্যে বা মতবাদে কবি বিশ্বাসী, তার প্রচার বা মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে রচিত হয় আরেক ধরনের কাব্য কবিতা। প্রথমোক্ত কাব্য ধারাকে ব্যক্তিগত কবিতা বললে, দ্বিতীয় ধারাকে বলা হয় বিষয়গত কাব্য। তবে, অবশ্যই স্বীকার্য যে, ব্যক্তিগত কাব্য বা কবিতাও কবির অন্তরের সত্যতার প্রকাশে বিশ্ববোধে উন্নীত হতে পারে। বস্তুত, কবির জীবনবোধের সত্যতার প্রকাশে কবিতা এই বিশ্ববোধ বা সার্বজনীনতার গুণ অর্জন করে। কবি নতুন কিছু সৃজনশীল শক্তি দ্বারা উদ্ভাবন করুন বা অন্য কোনো মতের ব্যাখ্যা করুন, মূল কথা হলো তাঁর অন্তরের প্রকাশে নবায়ন ঘটানো। এই দুই ধরনের রচনা ধারার একটি হচ্ছে Lyric এবং অন্যটি হচ্ছে Ode।

Lyric অর্থে গীতি কবিতা। যে কবিতার মধ্যে কবির উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতা বিভিন্ন প্রকারে গীতিরসের মাধুর্য সহকারে প্রকাশিত হয়। যে কাব্য বা কবিতায় সুরের উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যায়, তাই Lyric বা গীতিকবিতা। আর Ode বলতে বোঝানো হয় স্তুতি-কবিতাগুলিকে। Ode-এর সংজ্ঞা নিরূপণ করে বিভিন্ন পাশ্চাত্য সাহিত্য সমালোচক মন্তব্য করেছেন— “A rimed (rarely unrimed) lyric, often in the form of an address; generally dignified or exalted in subject, feeling and style।”

অথবা, “Any strain of enthusiastic or exalted lyrical verse, directed to a fixed purpose and dealing progressively with a dignified theme.”

বস্তুত, স্তুতিবাচক বা স্তুতিমূলক কবিতা মাত্রই Ode। Ode-এর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি কবিতা—

“হে বঙ্গ ভাঙারে তব বিবিধ রতন

তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি

পরধনে লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ

পর দেশে ভিক্ষা বৃত্তি কুক্ষণে আচরি।”

কিম্বা, সর্বজন পরিচিত সাহিত্য সম্রাটের দেশ বন্দনা—

“বন্দে মাতরম্

সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং

শস্য শ্যামলাং মাতরম্”

—গানের কথাও উল্লেখ করা যায়। এ গানও Ode। Ode-র মধ্যে Lyric ধর্মীতা থাকতেও পারে। যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান—

“পতিতোদ্ধারীণি গঙ্গে

শ্যাম-বিটপি ঘন তট বিপ্লাবিনী

ধূষর তরঙ্গ ভঙ্গে”

গীতিময়তা থাকলেই যে তা Lyric হবে এমন নয়। গীতিকবিতার ধরনেও Ode বা স্তুতিমূলক কবিতা রচিত হতে পারে।

মাইকেল মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্য ঐতিহ্য আশ্রয়ী হলেও Ode নয়। কেননা এখানে কারো স্তব বা স্তুতি প্রাধান্য লাভ করেনি। এখানে নায়িকাদের চিত্তবৃত্তি ভেদে হৃদয়-উচ্ছৃত আবেগ, সামাজিক পরিবেশ এবং তাঁদের সাধ্য সাধনের সংঘাতে একটি গীতরসের সৃষ্টি হয়েছে। নাটকীয় সংঘাতের ফলে গীতিধারা নিঃসৃত হয়ে বীরাঙ্গনা কাব্যকে Lyric করে তুলেছে।

কাব্যে, কবিতায়, গল্পে, নাটকে এবং সমস্ত সৃজনশীলতার মধ্যে গীতিরসজাত হয় আবেগ থেকে, কিংবা বলা যেতে পারে আবেগের দ্বন্দ্ব থেকে। অপূর্ণ মানুষ যখন কল্পনায় পূর্ণতার সন্ধান করে তখনই তার মধ্যে আসে লিরিক-প্রেরণা। বীরাঙ্গনার তারার পত্রে যেমন করে ফুটে উঠেছে লিরিকধর্মিতা—

“কুলের পিঞ্জর ভাঙ্গি-কুল-বিহঙ্গিনী

উড়িল পবন-পথে, ধর আসি তারে

তারানাথ।”

কিম্বা—

“এস তবে প্রাণসখে। তারানাথ তুমি

জুড়াও তারার জ্বালা! নিজ রাজ্য ত্যজি

ভ্রমে কি বিদেশে রাজা, রাজকাজ ভুলি?

সদর্পে কন্দর্প নামে মীনধ্বজ রথী

পঞ্চ খর শর তূণে, পুষ্প ধনুঃ হাতে

আক্রমিছে পরাক্রমি অসহায় পুরী

কে তারে রক্ষিবে, সথে, তুমি না রক্ষিলে?”

বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্যে কোথাও কোথাও Ode ধর্মীতা লক্ষ্য করা যায়। কাব্যের প্রয়োজনে, নাটকীয়তা বজায় রাখতে কিংবা নায়িকার পরিহাস বা নায়কের মধ্যে উদ্দীপ্ত রস সঞ্চারের জন্য কিছু কিছু পত্রিকার মধ্যে Ode জাতীয় স্তুতিবাচক অংশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন দ্রৌপদী পত্রিকায় অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর প্রেম ও আস্থার পরিচয় দিতে কিছু অংশে স্তুতি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়—

“পাণ্ডব-কুল-ভরসা, মহেষ্বাস, তুমি।

বিমুখিবে তুমি, সথে, সম্মুখ সমরে

ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ শুরে; নাশিবে কৌরবে।”

কিম্বা—

“কে শিখায় অস্ত্র তোমা, বহ, সুরপুরে,

অস্ত্রী-কুল, গুরু তুমি? এই সুর-দলে

প্রচণ্ড গাণ্ডীবে তুমি টঙ্কারি হুঙ্কারে

দমিলা খাণ্ডব রণে? জিনিলা একাঙ্কী

লক্ষ রাজে, রথীরাজ লক্ষ্য ভেদ কালে

নিপাতিলা ভূমিতলে বলে ছদ্মবেশী

কিরাতেরে।”

গীতিকবিতা বা Lyric-এর অপর একটি লক্ষণ হল, এ কবিতায় কোনো গল্প, আখ্যান বা কবিতার মধ্যে সংলাপ মুখরতা থাকতে পারে। সেদিক থেকে বিচার করতে বসলে দেখা যায় বীরাঙ্গনা কাব্য পৌরাণিক কাহিনীর উপাদান নিয়ে গঠিত। যদিও কবি মধুসুদন তাঁর কাব্যের প্রয়োজনে কখনও কখনও পৌরাণিক উপাদানগুলির কিছু কিছু পরিবর্তন সাধন করেছেন, তবুও সেখানে একটি আখ্যান বস্তু থেকে গেছে। আরও লক্ষ্য করা যায় এ কাব্যের সংলাপ মুখরতা। পত্রাকারে লিখিত কাব্যগুলির মধ্যে নায়িকা বা পত্রিকা প্রেরিকার মনের কথা ব্যক্ত হয়েছে। যার ফলে বীরাঙ্গনা কাব্য Dramatic Monologue বা একোক্তিমূলক কবিতায় পরিণত হয়েছে। এই একোক্তিমূলকতাই কাব্যের নায়িকাকে বাস্তবের আলোকে পাঠকের সামনে এনে দাঁড় করায়। উদাহরণস্বরূপ, বীরাঙ্গনা শকুন্তলার পত্রিকার প্রথমাংশ অনায়াসেই উল্লেখ করা যায়—

“বন-নিবাসিনী দাসী নমে রাজপদে

রাজেন্দ্র! যদিও তুমি ভুলিয়াছ তারে

ভুলিতে তোমারে কভু পারে কি অভাগী?”

এই একোক্তিমূলক সংলাপ প্রবণতা বীরাঙ্গনা কাব্যকে গীতিকবিতা রূপে গড়ে তুলতে অনেকাংশে সহায়তা করেছে।

ইতিপূর্বে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর গীতিকাব্য রচনা করার নিখুঁত নিদর্শন বা প্রমাণ দান করেছেন আত্মবিলাপ, ব্রজাঙ্গনা বা মেঘনাদবধের চতুর্থ সর্গে। মধুসুদন ছিলেন বৈচিত্র্য প্রয়াসী। তাঁর রচনায় যেমন বিভিন্ন ধারা লক্ষ্য করা যায়, রচনা কৌশলেও তেমনি তিনি বৈচিত্র্যের সন্ধান করেছেন। তাই ব্রজাঙ্গনা বা মেঘনাদবধ কাব্যের চতুর্থ সর্গের রীতি অনুসারে গীতিকবিতা রচনা না করে বীরাঙ্গনা কাব্যে ভিন্ন রীতির অবলম্বন করেছেন। নারী জীবনের নিঃসঙ্গতার মধ্যে দিয়ে নারীর ব্যক্তিত্বের মহিমা প্রকাশ করতে কাব্যরীতির Subjective ও Objective-এর সাযুজ্য ঘটিয়েছেন স্বীয় প্রতিভার প্রয়োগ কুশলতায়। ফলে প্রতিটি নায়িকার সাধ ও সাধ্যের সংঘাতে নাটকীয়তা অনিবার্য হয়ে উঠেছে তার ঘাত-প্রতিঘাতে উত্থিত আবেগ থেকে কাব্যে গীতিরসধারা নিঃসৃত হয়ে বীরাঙ্গনা কাব্যকে বহুলাংশে গীতি কবিতার মর্যাদা দান করেছে।

কাহিনী বা ঘটনা সংঘটনের সঙ্গে মননঋদ্ধতাও গীতিকবিতার অন্যতম একটি লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। আমরা দেখেছি, মননঋদ্ধতা বীরাঙ্গনা কাব্যে বর্তমান। বস্তুত, কোনো রসের সার্থক প্রয়োগের জন্য কাব্যিক বিষয়েও আত্মতত্ত্বের সম্মুখীন হয় কাব্যপ্রণেতা। কাব্যের উদ্দীপনায়, আদর্শ কাহিনীর স্বল্প সময়ে অন্তর দৃষ্টি কাব্যের সৃজনশীলতার পটভূমি প্রস্তুত করে।

বীরাঙ্গনার স্থান ও গুরুত্ব

বীরাঙ্গনা কাব্যের স্থান প্রাচ্য সাহিত্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কাব্য সাধনার মাধ্যমে বাঙালি কাব্যচর্চার সুর, রূপ ও অর্থরূপ সৃষ্টি করেছে। মধুসূদন দত্তের গীতিকবিতার পূর্ণতা এবং কাব্যপদ্ধতির ঋদ্ধি বৃদ্ধির পথে তাঁর মেধার প্রমাণ রাখার উদ্দেশ্যেই এই কাব্য রচিত হয়েছে। বীরাঙ্গনার মধ্যে পূর্ণতা পেয়েছে বাঙালি কবিতার বৈশিষ্ট্য।

উল্লেখযোগ্য যে, কাব্যটির স্তব, স্তুতি বা এর উত্থাপিত ব্যক্তিত্ব কাব্যরূপে নিবেদিত হয়। প্রতিটি নায়িকার বিশেষত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে সৃজনশীলতার রীতির ধারায় পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে কাব্যটির গভীরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কাব্যটির শক্তি ও কাব্যগুণ মননঋদ্ধতা নির্ভরতার প্রমাণ রাখে। সবশেষে, বীরাঙ্গনা কাব্যের বাণী বাঙালি কাব্য সাহিত্যের ঐতিহ্যের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.