Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

বীরাঙ্গনা কাব্যের শ্রেষ্ঠ পত্রিকা কোনটি?

যুগন্ধর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে বৈচিত্র্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। কাব্য, মহাকাব্য, পত্রকাব্য, সনেট—এগুলির মধ্যে পুনরাবৃত্তি দেখা যায় না। তাঁর সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে অভিনব এবং অনবদ্য তাঁর পত্রকাব্য—বীরাঙ্গনা কাব্য। যদিও মেঘনাদবধ কাব্য তাঁর অত্যুজ্জ্বল প্রতিভার কালজয়ী সৃষ্টি হিসেবে পরিচিত, বীরাঙ্গনা কাব্যও তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপে বিবেচিত। ভাষা, ভাব, এবং ত্রুটি-ভ্রষ্ট ছন্দে এর অনবদ্যতা সর্বজন স্বীকৃত।

বীরাঙ্গনা কাব্য হল একটি পত্রকাব্য। এটি পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে সংগৃহীত এগারোজন নায়িকার হৃদয়াবেগ উদ্ধৃত একোক্তিমূলক রচনা। নায়িকাগণ কর্তৃক তাঁদের প্রেমাস্পদ বা পতির উদ্দেশ্যে লিখিত এবং প্রেরিত পত্রিকা বা লিপির সংকলন হল বীরাঙ্গনা কাব্য। রোমক কবি ওভিদের ‘দি হিরোইডেস’ কাব্যের আদর্শে প্রেরিত হয়ে কবি মধুসূদন বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেছিলেন। বলা বাহুল্য, পাশ্চাত্য কবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেও এবং ভারতীয় পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করলেও, বীরাঙ্গনা কবির মৌলিক কবিত্ব শক্তির স্বাক্ষরবাহী।

বীরাঙ্গনা কাব্যের মূল সুর প্রেমের সুর। তবুও, পত্রগুলির মধ্যে নায়িকাদের স্বভাব চরিত্রভেদে স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। মোট চারটি শ্রেণীতে এই কাব্যের পত্রগুলিকে বিন্যস্ত করা হলেও, এগারোটি পত্রই স্বতন্ত্র ভাব ও রসের বাহক। যেমন, শকুন্তলা ও দ্রৌপদী উভয়েই প্রোষিতভর্তৃকা। উভয়েই স্বামীর অনুপস্থিতির কারণে উৎকণ্ঠিত। পতির মিলনের পিয়াসী এই দুই নারীর চিঠির বিষয়বস্তু এক ধরনের হলেও, দুটি পত্রের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। এই ভিন্নতা দুই নারীর স্বভাব চরিত্র ও মনোভাবের কারণে। শকুন্তলা সরলা আশ্রমকন্যা। তিনি কোমল স্বভাবযুক্ত। উচ্চ কণ্ঠে তিনি কথা বলতে পারেন না এবং নিজের বিরহজনিত কারণে প্রাপ্ত দুঃখের জন্যে তিনি দুষ্মন্তকে দায়ী না করে নিজের মন্দভাগ্যের প্রতি দোষারোপ করেন। তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত হল পতির কল্যাণ সাধন। তাই দুখস্তের কথা এবং নিজের বিরহব্যথার কথা কারো কাছে তিনি প্রকাশ করতে পারেন না, পাছে কেউ শকুন্তলার দুঃখ দেখে দুষ্মন্তের প্রতি কুবাক্য বলে কিম্বা বনদেব বনদেবী রুষ্ট হয়ে দুষ্মন্তকে অভিশাপ দেন। শকুন্তলার বিরহ বেদনা তাই তার একার।

অন্যদিকে, দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর মধ্যে কেবল অর্জুনের জন্য বিরহে কাতর। অর্জুন ইন্দ্রলোকে অস্ত্র শিক্ষা করতে গেছেন। তার বিরহ দ্রৌপদীর আর সহ্য হচ্ছে না। দ্রৌপদী শকুন্তলার মতো সম্বৃতবাক নন। তিনি বাকপটু। কাজেই তাঁর পত্রেও সেই মুখরতা লক্ষ্য করা যায়। অর্জুনকে তিনি দাম্পত্য প্রেমের দাবীতে কটাক্ষ করেছেন। অর্জুন যে মনোরমা স্বর্গের অপ্সরীদের সেবা যত্নে কাল যাপন করছেন, তাতে তাঁর পক্ষে দ্রৌপদীর কথা মনে রাখা সম্ভব কিনা—এ বিষয়ে কটাক্ষ করে দ্রৌপদী অর্জুনকে বিদ্ধ করতে চেয়েছেন। নানা পূর্ব কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অর্জুনের হৃদয়ে পুরনো প্রেমের নবস্রোতোদ্বেলতা আনবার চেষ্টা করেছেন। দ্রৌপদীর স্ত্রীর দাবী প্রতিষ্ঠিত, সেই দাবীতেই দ্রৌপদী অর্জুনকে ফিরে এসে বিরহের অবসান ঘটাতে আহ্বান জানিয়েছেন। আলোচ্য দুটি পত্রিকাই প্রোষিতভর্তৃকার বিরহ সংজ্ঞাপক পত্রিকা। দুটি পত্রিকার মূল বক্তব্য এক। কিন্তু নায়িকাভেদে পত্রিকা দুটির ভাব ও ভাষায় স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। এই রকমই একই ভাবাশ্রিত অনুযোগ পত্রিকা দুটির মধ্যেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। দশরথ পত্নী কেকয়ী ও নীলধ্বজ পত্নী জনা তাঁদের স্বামীদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে অভিমানী চিত্তে দুটি অনুযোগ পত্রিকা রচনা করেন।

কেকয়ী তাঁর দাসী মন্থরার মুখে রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার সংবাদ শুনে দশরথের প্রতি ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। কেননা, একদা দশরথ কেকয়ীর সেবায় তুষ্ট হয়ে কেকয়ী-নন্দন ভরতকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করবেন কথাটি বলেছিলেন। কিন্তু কার্যকালে কৌশল্যানন্দন, জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করলে কেকয়ী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁর পুত্রস্বার্থ রক্ষার আন্দোলন ক্রমে পরিণত হয় সত্য বিচার প্রার্থনায়। কেননা, একদা যে সত্য দশরথ কেকয়ীর কাছে করেছিলেন, আজ তিনি সে সত্য থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন। কাজেই ‘পরম অধর্মাচারী রঘু-কুল পতি’ কথাটি চতুর্দিকে রাষ্ট্র করতে তিনি বদ্ধপরিকর হয়ে যান এবং পত্রের শেষে সত্যের অপলাপ ঘটানোর জন্য ধর্মের দোহাই দিয়ে দশরথের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেন ও সপুত্র তিনি রাজপুরী ত্যাগ করার বাসনা প্রকাশ করেন। কেকয়ীর পত্রে তাই অবশেষে আত্মস্বার্থ, পুত্রস্বার্থের চেয়েও সত্যের বিচার প্রার্থনা বড় হয়ে উঠেছে।

মাহেশ্বরী রাজ্ঞী জনার স্বামীর প্রতি অভিযোগের কারণ ভিন্ন। অর্জুনের সঙ্গে সম্মুখ সমরে তাঁর বীরপুত্র প্রবীর বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে। এই খবর শুনে জনা মর্মাহত। কিন্তু বীরপুত্রের রণক্ষেত্রে বীরগতি প্রাপ্ত হওয়ায় শোকের চেয়ে ক্ষত্রিয় রমণী হিসেবে গর্ব অনুভব করেছেন। কিন্তু যখন শুনলেন তাঁর স্বামী অর্থাৎ প্রবীরের পিতা, পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়ে, পুত্র হস্তারককে পরমমিত্র জ্ঞানে রাজপুরীতে আশ্রয় দিয়েছেন। নরনারায়ণ জ্ঞানে অর্জুনকে পূজা করছেন। অর্জুনের তুষ্টি বিধান করতে রাজসভায় নাচ-গানের আনন্দময় বাতাবরণ সৃষ্টি করছেন তখন জনা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। তিনি স্বামীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, ক্রুদ্ধ হয়েছেন। তিনি নানাভাবে স্বামীকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। এখানে লক্ষ্যণীয়, এত সত্ত্বেও জনার স্বামী প্রেম, স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির হানি হয়নি। ক্ষত্রিয় রমণী হিসেবে তাঁর আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগলেও স্বামীকে তিনি অবমাননা করেননি। এই পত্রিকা বীরাঙ্গনা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রিকা হলেও, আমাদের মতে, এটি সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকা রূপে গণ্য হওয়ার যোগ্য।

বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্যে কবি মধুসূদন নারীত্বের প্রতি মর্যাদা দান করেছেন। এছাড়া এর মধ্যে ভাষা ও ভাবের নতুনত্বও দেখা যায়। শকুন্তলা, দ্রৌপদী, কেকয়ী-জনার পত্রিকার প্রেক্ষাপট ছিল গতানুগতিক। কিন্তু একজন বিরহী স্ত্রীর ভাবনা কিংবা বীরাঙ্গনার ক্ষোভ প্রকাশের ঘটনার চেয়ে বিবাহিতা স্ত্রীর পক্ষ থেকে, বিশেষত যখন যে ঋষি-কন্যা ও ঋষিপত্নী তার পক্ষে অবৈধ প্রেম সম্ভাষণ, তা যুগে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা। বস্তুত, বীরাঙ্গনা কাব্যের সূত্রধারেই বাংলা সাহিত্যে অবৈধ প্রেম কাহিনীর প্রচলন ঘটে।

তারা পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল রত্ন। মুক্তপ্রেমের বা প্রেমমুক্তির জয়গান এখানে গীত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, দাম্পত্য প্রেম বৈচিত্র্যহীন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ঘড়ার জল’ প্রয়োজন মতোই সে প্রেমের ব্যবহার প্রকাশ ও আস্বাদন। কিন্তু পরকীয়া প্রেম যেন ‘সাঁতার পানি’। যত ইচ্ছে, যেমন ইচ্ছে উদ্দামতা সেখানে অনায়াসে প্রকাশ করা যায়। সাহিত্যে তাই এই আবেগমথিত সমাজনিন্দিত প্রেমই নন্দিত হয়েছে।

বৃহস্পতি-পত্নী তারা তাঁর পত্রিকা ‘গ্রীষ্ম’ ১৬১৫ সনেটে, যা মোট কাব্যের তিনভাগে বিভক্ত, স্নেহাশ্রিত অনুচ্ছেদে বর্ণনা করেছেন। কবির লেখা প্রবন্ধ ও সমালোচনা অনুযায়ী, তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্যের নাট্যশৈলীতে কবির সৃজনশীলতা স্বতন্ত্র। কবি মহাকাব্য চর্চার পাশাপাশি ‘পত্রকাব্য’ ভঙ্গিতে প্রেমবিষয়ক বিরহের সাহিত্য আকারে কাব্য রচনা করে সৃজনশীলতার নতুন জগৎ সৃষ্টি করেছেন। প্রেম, বিরহ, বিপন্নতা ও স্বাবলম্বনের দিক থেকে কাব্যটি সাহিত্য জগতের এক নতুন অবদান স্বরূপ।

বীরাঙ্গনা কাব্যের সঙ্গে বিভিন্ন সংস্কৃত উপাদান মিললেও, কবির নিজের শৈলী, কবিতা ও সৃজনশীলতার মোহনায় কাব্যটি অমূল্য। বিশেষত মাইকেল মধুসূদন দত্তের আধুনিক যুগের সৃজনশীলতা, সাহিত্যের সৃজনশীল কার্যপ্রণালী ও ভাষার বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করার ক্ষেত্রেও এটি অনন্য।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই কাব্য বাংলা কাব্যচর্চার একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে, যা পাঠক ও গবেষকদের জন্য সাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

শওকত আলী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

শওকত আলী (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ – ২৫ জানুয়ারি ২০১৮) বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্মের জন্য

Read More

লােকসাহিত্য কাকে বলে?

লােকের মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা, কাহিনী, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি হলাে লােকসাহিত্য হলাে। লোকসাহিত্য মূলত বাককেন্দ্রিক। কেবল মৌখিক নয়, ঐতিহ্যবাহীও, অর্থাৎ লোকপরম্পরায় লোকসাহিত্য মুখে মুখে

Read More

সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করো!

সাহিত্য: ‘সাহিত্য’ শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে এসেছে। এখানে সহিত শব্দের অর্থ- হিত সহকারে বা মঙ্গলজনক অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পর্কে বলেন, “একের সহিত অন্যের মিলনের মাধ্যমই হলো

Read More

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.