নবজাগরণের মহান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পৌরাণিক নারী চরিত্র নিয়ে যে অসাধারণ ধ্রুপদী সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, তা রোমক কবি পাবলিয়াস ওভিদিয়াস নাসো বা ওভিদের রচনাগুলোর দ্বারা প্রভাবিত। ওভিদের “হিরোইডেস” (Heroides)-এর মতোই, মধুসূদন তার কাব্যে পৌরাণিক নারী চরিত্রগুলোকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন। এখানে বিভিন্ন নারী চরিত্র চয়ন করা হয়েছে—সতী, সাধ্বী থেকে শুরু করে সধবা, বিধবা এবং অনূঢ়া নারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বীরাঙ্গনা কাব্যে এই নারী চরিত্রগুলির মনোভাব, বিশেষত প্রেমমূলক মানসিকতার দিকটি অত্যন্ত গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই কাব্যের নায়িকারা সবাই সবলা, যারা নিজের বক্তব্য নিজেরাই পেশ করতে সক্ষম। তাঁদের প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী, মহিয়সী এবং প্রেমের ক্ষেত্রে নির্ভীক। মধুসূদন তাঁদের প্রতিটিকে স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
বীরাঙ্গনা কাব্যের দ্বিতীয় সর্গে স্থান পেয়েছে সোমের প্রতি তারার লেখা একটি পত্রিকা। বৃহস্পতির পত্নী তারা, সোম বা চন্দ্রের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে এই প্রেমপত্রটি রচনা করেন। এই পত্রিকা থেকে তারার যে চরিত্র ফুটে ওঠে, তাতে মধুসূদন তাঁকে একটি বিদ্রোহিনী নায়িকা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, তা স্পষ্ট। তারা প্রকৃতপক্ষে মধুসূদনের মৌলিক সৃষ্টির এক উদাহরণ।
দেবগুরু বৃহস্পতির পত্নী তারা স্বামীর শিষ্য সোমকে যে পত্র লিখেছিলেন, তাতে তার প্রেম বাসনার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। বৃদ্ধ দেবগুরু বৃহস্পতি—জ্ঞানী, তপস্বী, এবং দেবসমাজে শ্রদ্ধেয়—তারার যৌবন এবং মনোভাবের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না। পত্রিকা থেকে বোঝা যায় যে তারা স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন এবং প্রেমের জন্য তীব্রভাবে আকুল ছিলেন। প্রেমবঞ্চিত হৃদয় নিয়ে তারা সংসারের দায়িত্ব পালন করতেন, শিষ্যদের মাতৃসম যত্ন করতেন। সেই অবস্থায় যখন চন্দ্র বিদ্যাধ্যয়নের জন্য বৃহস্পতির কাছে আসেন, তারার প্রেমাশক্ত মন তখন থেকে চন্দ্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রথম দর্শনেই তারা চন্দ্রের প্রতি মুগ্ধ হন, যদিও তা প্রকাশ করতে সাহস পাননি। কিন্তু বিদ্যাধ্যয়ন শেষে যখন চন্দ্র বিদায় নিতে প্রস্তুতি নেন, তারা তখন তার মনের কথাগুলি প্রকাশ করেন এবং একটি পত্রে নিজের অনুভূতিগুলি ব্যক্ত করেন। পত্রে তিনি উল্লেখ করেন কিভাবে তিনি নিঃশব্দে চন্দ্রের সেবা করে এসেছেন, চন্দ্রকে তাঁর পতি জ্ঞান করে—তার বর্ণনা দেন।
মধুসূদনের এই রচনা পৌরাণিক যুগের প্রেমকে আধুনিক যুগোপযোগী করে তুলে ধরেছে। প্রাচীন সমাজে বিবাহিত স্ত্রীর পক্ষে অন্য পুরুষের প্রতি প্রেম আকাঙ্ক্ষা নিন্দিত হলেও, মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যে তারার এই প্রেমপত্রিকা সাহিত্য সমাজে প্রশংসিত হয়েছে। এই ধারার শুরু থেকেই সাহিত্যে নারী চরিত্রের বিদ্রোহ এবং অবৈধ প্রেমমূলক গল্পের উত্থান শুরু হয়। বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের মতো লেখকরাও তাঁদের রচনায় নারী চরিত্রের এই বিদ্রোহী সত্তাকে তুলে ধরেছেন। তাঁদের কাব্য এবং সাহিত্যে সৃষ্টি হয়েছে শক্তিশালী নারী চরিত্র, যারা অনেকেই তারার মতো বিদ্রোহিনী।
বৃহস্পতির আশ্রমে তারার উন্মুক্ত যৌবন ও প্রেম বাসনার তৃপ্তির কোনো উপায় ছিল না, কারণ তার স্বামী ছিলেন বৃদ্ধ, প্রাজ্ঞ, এবং তপস্বী। সংসারের কাজ এবং আশ্রমিকদের সেবা করেই তারার সময় কেটে যেত। কিন্তু চন্দ্র যখন বৃহস্পতির কাছে বিদ্যা অধ্যয়ন করতে এলেন, তারার মনের অবদমিত বাসনা এবং প্রাণের আবেগ নতুন করে জেগে উঠল। প্রাথমিকভাবে তারার প্রণয়াকাঙ্ক্ষা গোপন থাকলেও, তারার পক্ষপাত স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। প্রেমিকের প্রতি যত্নশীলতা প্রেমিকার জন্য যে আনন্দ বয়ে আনে, তারা সেই আনন্দ উপভোগ করতে সচেষ্ট হন। প্রেমিকার মতোই তারা চন্দ্রের আহার-বাহারের প্রতি যত্ন নিতেন, তার পরিশ্রম লাঘবের চেষ্টা করতেন। এ সব কথাই তারার পত্রিকায় উঠে এসেছে।
“গুরুর প্রসাদ-অম্লে সদা ছিলা রত তারাকান্ত; ভোজনাত্তে আচমন-হেতু যোগাইতে জল যবে গুরুর আদেশে বহির্দ্বারে, কত যে কি রাখিতাম পাতে চুরি করি আনি আমি।”
প্রথম দর্শনেই তারার চন্দ্রের প্রতি প্রেম জন্মেছিল, যদিও তিনি তা প্রকাশ করতে পারেননি। তবে বিদ্যা অধ্যয়ন শেষে চন্দ্র বিদায় নিতে প্রস্তুতি নিলে তারা তার প্রণয়াকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন। তারার প্রেমের আবেগ যতই তীব্র হোক না কেন, তিনি সমাজের রীতিনীতির প্রতি সচেতন ছিলেন। পত্র শুরু করেই তিনি নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন, তার লেখনীকে অভিশাপ দিয়েছেন। তিনি নিজেকে নিজের সামাজিক অবস্থানের জন্যও ধিক্কার দিয়েছেন।
তারা আসলে নতুন প্রেমিকাকে ঈর্ষা করতেন, চন্দ্রের প্রথমা স্ত্রী রোহিণীকে। নিশাযোগে পদ্ম ফুল প্রস্ফুটিত হলে তিনি রোহিণীকে চন্দ্রের প্রেমিকা মনে করে সেই পদ্ম ফুল ছিঁড়ে ফেলতেন। তারার এই ঈর্ষা তাঁর প্রেমের চরম প্রকাশ। নতুন প্রেমের আবেগ ঈর্ষার সৃষ্টি করে, তবে প্রেম সম্পর্কে আস্থা জন্মানোর সাথে সাথে তা অন্তর্হিত হয়।
মাইকেল মধুসূদনের তারা পৌরাণিক সতী সাধ্বী তারার মতো নন। মধুসূদনের তারা স্বতন্ত্র এবং বিদ্রোহিনী।