Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

টিনের তলোয়ার নাটকের সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করো

“টিনের তলোয়ার” নাটকের সমাজতত্ত্ব বুঝতে হলে উৎপল দত্তের সামাজিক মনোভাবও বোঝা জরুরি। কোন মন নিয়ে এবং কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি উনিশ শতকের নবউত্থিত বাঙালি বাবু ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে দেখতে চেয়েছেন? সমাজের পরিবর্তনের পথে তাঁরা কী ভূমিকা পালন করেছেন? রাজনৈতিক বিপ্লবের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের যোগসূত্র একটি সমাজকে বোঝার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ? দ্বন্দ্বমূলক চিন্তায় পৃথিবীর সবকিছু পরিবর্তনশীল। সমাজের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে ব্যক্তিমান সামাজিক মনে রূপান্তরিত হয়, যা একটি পরিবর্তনশীল ও ক্রমবিকাশশীল প্রক্রিয়া। সামাজিক মন কখনোই স্থির বা অনড় নয়, আবার খুব সহজে এর পরিবর্তনও ঘটে না। প্রতিনিয়ত সবকিছু নিজের বিপরীতে রূপান্তরিত হচ্ছে—এটাই পরিবর্তনের মূল কথা। এই পরিবর্তন বুঝতে হলে সমাজকে, কিংবা সমাজের অন্তর্গত ব্যক্তিকে, গভীরভাবে জানতে ও বুঝতে হবে। এখানে “টিনের তলোয়ার” নাটকে উৎপল দত্ত উনিশ শতকের সামন্ততান্ত্রিক বঙ্গসমাজকে দেখাতে চেয়েছেন, যা বুর্জোয়া সমাজে পরিণত হওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে।

উনিশ শতকের বঙ্গ সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব ছিল প্রাচীন ভূমিসম্পর্ক এবং কৃষির বাণিজ্যিক রূপায়ণের মধ্যে। ব্রিটিশরা ভারতে আসার পর ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। অষ্টাদশ থেকে উনিশ শতকের মধ্যে ব্রিটিশ কৃষিনীতি দুইটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে—প্রথমত, আরও বেশি রাজস্ব আদায়ের লোভ, এবং দ্বিতীয়ত, রপ্তানির জন্য বিশেষ কয়েকটি কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়ার বাসনা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার জমিদাররা কখনও ব্রিটিশ ধাঁচের উদার ভূস্বামী হয়ে ওঠেননি। তাদের খাজনা আদায়ের প্রায় কোনও সীমাবদ্ধতা ছিল না, অথচ রাজস্ব প্রদানের ক্ষেত্রে বাধা ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তারা পুঁজিবাদী চাষের ঝুঁকি নিতে চায়নি, বরং সামন্ততান্ত্রিক ও সুদখোরি শোষণ তাদের বেশি আকৃষ্ট করেছিল। এই জমিদার শ্রেণির নিচে ছিল মধ্যবর্তী তালুকদার, যারা বাঙালি ভদ্রলোকদের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল।

সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিচারে, যদিও স্তরভেদে কিছুটা অসম, তবু প্রিয়নাথ মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ, বেণীমাধব চট্টোপাধ্যায় এবং “টিনের তলোয়ার” নাটকের মথুর চরিত্র এই ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বৈদেশিক বাণিজ্য, জাহাজ ব্যবসা এবং বিমা কার্যত ব্রিটিশ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। রপ্তানির মুনাফার বেশিরভাগ বিদেশি সংস্থাগুলি আত্মসাৎ করত, কিন্তু ভারতীয় ব্যবসায়ী ও মহাজনেরাও ভালো মুনাফা পেত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ এবং এ সময়ের থিয়েটার ব্যবসায়ীরা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এ সময় পাশ্চাত্য ইংরেজি শিক্ষার কারণে নতুন এক বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে, যারা সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মতো বুর্জোয়া আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়। সেই সময়ের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সঙ্গে তাদের অ-বুর্জোয়া সামাজিক ভিত্তির যে বৈপরীত্য ছিল, তা “টিনের তলোয়ার” নাটকে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

বেণীমাধব ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণের দ্বন্দ্ব ও সমঝোতা, প্রিয়নাথের প্রতি বেণীমাধবের স্নেহ, ভালোবাসা এবং ঈর্ষা, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও প্রিয়নাথের প্রেম, অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি, ময়নার প্রতি বেণীমাধবের মাতৃস্নেহ, বসুন্ধরার প্রতি বেণীমাধবের সখ্য ও দাসসুলভ মনোভাব, এবং মথুরের বাবু সমাজের প্রতি ঘৃণা—এই জটিল সম্পর্কের মধ্য দিয়ে উৎপল দত্ত উনিশ শতকের বঙ্গ সমাজের ছবি এঁকেছেন। তিনি এই সমাজকে বিশ শতকের ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন। নাটকের চরিত্রগুলির—বেণীমাধব, প্রিয়নাথ, ময়না, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, বসুন্ধরা—এই আপাত বৈপরীত্যের মধ্যে নাটকটির ভারসাম্য বজায় ছিল। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রবিশেষে প্রিয়নাথ, ময়না, বসুন্ধরা, এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বিভিন্ন কৌণিক অবস্থানে অবস্থান করেছেন, যখন বেণীমাধব ছিলেন কেন্দ্রে। বাচস্পতি, ল্যাম্বার্ট, এবং মথুর তাদের সামাজিক শ্রেণির তারতম্য অনুযায়ী বেণীমাধবের চারপাশে অবস্থান করেছে।

নাট্যকার উৎপল দত্ত বিশ্বাস করতেন, “সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া রাজনৈতিক বিপ্লব সম্পূর্ণ হতে পারে না।” ঊনিশ শতকের সমাজে এটি কতটা সম্ভব ছিল বা ছিল না, সে বিতর্কে না গিয়ে, বিশ শতকের রোমান্টিক বিপ্লবী চিন্তাধারায় নাটকের শেষে বেণীমাধবের হাতে টিনের তলোয়ার তুলে দিয়েছেন তিনি। অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং শিল্পের জীবনে নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে টিনের তলোয়ার নামক সাংস্কৃতিক হাতিয়ার নিয়ে উৎপল দত্ত বিদ্রোহের প্রাঙ্গণে এক অনন্য আসনে বসেছেন। সামাজিক মন ও ব্যক্তিমনের দ্বন্দ্বে নির্দিষ্ট হয়ে ওঠে একটি বিশেষ সমাজের সামগ্রিক রূপ।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

শওকত আলী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

শওকত আলী (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ – ২৫ জানুয়ারি ২০১৮) বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্মের জন্য

Read More

লােকসাহিত্য কাকে বলে?

লােকের মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা, কাহিনী, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি হলাে লােকসাহিত্য হলাে। লোকসাহিত্য মূলত বাককেন্দ্রিক। কেবল মৌখিক নয়, ঐতিহ্যবাহীও, অর্থাৎ লোকপরম্পরায় লোকসাহিত্য মুখে মুখে

Read More

সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করো!

সাহিত্য: ‘সাহিত্য’ শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে এসেছে। এখানে সহিত শব্দের অর্থ- হিত সহকারে বা মঙ্গলজনক অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পর্কে বলেন, “একের সহিত অন্যের মিলনের মাধ্যমই হলো

Read More

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.