Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

টিনের তলোয়ার নাটকের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ চরিত্রের স্বরূপ বিশ্লেষণ করো

টিনের তলোয়ার নাটকের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দা একজন বেনিয়া মুৎসুদ্দি এবং গ্রেটবেঙ্গল অপেরার স্বত্বাধিকারী। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মুৎসুদ্দি হলেও অশিক্ষা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন, কিন্তু তিনি বণিক। উগ্র রুচিহীন বাবুজনোচিত পোশাক পরা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ এক সাহেবের মুৎসুদ্দি। নিজের বাইশ লক্ষ টাকা তাঁর নগদে খাটে। নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে মহলাকক্ষে তাঁর আগমন মাত্র তিনি তাঁর ঐশ্বর্যের বর্ণনা দিতে বসেন—“আমার চার ঘোড়ার গাড়ি। ব্রুহাম, চারটে ঘোড়ার তিনটে ওয়েলার, একটা নর্মাণ্ডি।” মহলাকক্ষে বসতে চাইলে গ্রেট বেঙ্গল অপেরার প্রৌঢ় অভিনেতা হরবল্লভ থিয়েটারে অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত সিংহাসনটি তাঁর দিকে এগিয়ে দেয়। সিংহাসনে বসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভৃত্যকে আদেশ দেন রুপোর পেয়ালায় আমেরিকা থেকে আনা মদ পরিবেশন করতে। এই মদ একজন মার্কিন সওদাগর বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে উপহার দিয়েছে।

সিংহাসনে বসেই প্রভুত্বমূলক সুরে তিনি রায় দেন যে দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ একটি বাজে নাটক। বঙ্কিমচন্দ্রকে নাটক লেখার জন্য ভাড়াও করতে চান। এইভাবে নাটকের প্রথমপর্বে বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে ধূর্ত, অশিক্ষিত, মূর্খ, অথচ বড়ো বড়ো কথা বলা ‘হামবাগ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কিন্তু সামাজিক ও আর্থিক নিয়মে এই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর কাছে গ্রেট বেঙ্গল অপেরা বাঁধা পড়েছে। তাই বেণীমাধব কাপ্তেনবাবুও বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মোসাহেবি করতে বাধ্য হন। শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি অসংবেদনশীলতা বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চরিত্রের মূলভাব হয়ে দাঁড়ায়, যা সামাজিকভাবেই অনিবার্য। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মতো মানুষদের জন্য শুধু টাকাই নয়, সামাজিক মর্যাদাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই মর্যাদার জন্যই তিনি থিয়েটারের মালিকানা নেন এবং রক্ষিতা পোষেন।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে ব্যবসার প্রফেশনাল দিক নয়, বরং কমার্শিয়াল বা বাণিজ্যের দিকটিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তাই তিনি বেণীমাধবকে বলেন—“আমার কমিশনের ব্যবসা, চোটার কারবার। তারপর আপনারাও যদি এমন ভজকট করেন।” বেণীমাধব ঘাবড়ে যান। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে জানান, মানদা সুন্দরী চলে যাওয়ার পর, যিনি তাদের থিয়েটারের নায়িকা ছিলেন, থিয়েটারে লোকসান হচ্ছে। এই সুযোগে বেণীমাধব সবজিওয়ালি ময়নাকে সাজিয়ে গুছিয়ে শহরের শিক্ষিতা রমণীর মিথ্যা পরিচয়ে শংকরী নব নামে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সামনে হাজির করেন। ময়নার সলজ্জ উপস্থিতি বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে ইন্দ্রিয়জ সুখানুভূতি দেয়। বেণীমাধব ময়নাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছ থেকে থিয়েটারের খরচ আদায়ের ব্যবস্থা করেন।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণের আরেকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল তাঁর ইংরেজ তোষণ। সাহেবদের সঙ্গে তাঁর ব্যবসা। আর থিয়েটারও তাঁর ব্যবসা, তবে প্রথমটি মুখ্য, দ্বিতীয়টি গৌণ। কিন্তু থিয়েটারের মাধ্যমে রক্ষিতা সরবরাহ ঘটায় তিনি গৌণ ব্যবসাটিকেও নগণ্য মনে করেন না। তবে নাটকে সাহেবদের গালাগালি দেওয়া তাঁর মোটেই পছন্দ নয়। তিতুমীরের অভিনয় প্রসঙ্গে তিনি অভিমত দেন, যারা সতীদাহ প্রথা নিবারণ করেছেন, সেই সাহেবদের এ নাটকে গাল দেওয়া হয়েছে। তাই তিনি নির্দেশ দেন, এ নাটক মঞ্চস্থ হবে না। থিয়েটারের মালিক হবার পর বেণীমাধব তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিতে না চাওয়ায়, তিনি ইংরেজ কর্তৃক নাট্যনিয়ন্ত্রণ অর্ডিনান্স জারি হওয়ার পর নাটক বন্ধ করার হুমকি দেন।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল তাঁর নারী ও সুরার প্রতি আকর্ষণ। সাহেবদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তিনি রূপোর পাত্রে বিলিতি মদ্য পান করেন। আমেরিকা থেকে আনা ‘আনিস’ নামক মদ, যা নামি দামি সাহেবরা পান করেন, সেটাও তিনি পান করার সুযোগ পান। আবার অন্য এক দৃশ্যে তাঁকে ‘লামেলো শ্যামপেন’ পান করতে দেখা যায়। তাঁর এই সুরা পানের অভ্যাসও উনিশ শতকীয় বাবু কালচারের অঙ্গ। তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের নারীপ্রীতি, নতুন রমণীবল্লভ হয়ে ওঠার স্পৃহা ঊনিশ শতকের বাংলার ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের এক চরিত্রকে নির্দেশ করে। থিয়েটারের মাধ্যমে তাঁর কাছে রক্ষিতা সরবরাহের উপায় হয়ে ওঠে। শংকরীর বেশে ময়নাকে দেখামাত্র যে পুলক তিনি অনুভব করেন, তা তুলনাহীন। তাঁর চরিত্রে নারীপ্রীতির সঙ্গে রমণীদের ওপর অত্যাচার করার বিকৃত মনোভাবও প্রকাশ পেয়েছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের রক্ষিতা ময়না বলেছে বসুন্ধরাকে—“ওই শয়তান বীরকেষ্ট তোমাদের মেয়েকে মারে জান? প্রিয়নাথের নাম করলেই মারে।”

সবশেষে, ময়না বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে দেহ দিয়েছে, কিন্তু মন দেয়নি। তার মনে প্রিয়নাথ অমলিন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সেটা বোঝে, তাই ময়না যখনই প্রিয়নাথের নাম করে, তখনই তাকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে হয়। নারী নির্যাতনের মাধ্যমে পুরুষের বিকৃত কামনা মেটানোর ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মধ্যে ফুটে উঠেছে। সব মিলিয়ে, উনিশ শতকের ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্র ও বিকাশমান পুঁজির ঔরসে বেড়ে ওঠা মুৎসুদ্দি বেনিয়া শ্রেণির একটি প্রামাণ্য চরিত্র হল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

লােকসাহিত্য কাকে বলে?

লােকের মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা, কাহিনী, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি হলাে লােকসাহিত্য হলাে। লোকসাহিত্য মূলত বাককেন্দ্রিক। কেবল মৌখিক নয়, ঐতিহ্যবাহীও, অর্থাৎ লোকপরম্পরায় লোকসাহিত্য মুখে মুখে

Read More

সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করো!

সাহিত্য: ‘সাহিত্য’ শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে এসেছে। এখানে সহিত শব্দের অর্থ- হিত সহকারে বা মঙ্গলজনক অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পর্কে বলেন, “একের সহিত অন্যের মিলনের মাধ্যমই হলো

Read More

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.