‘প্রহসন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল—প্রকৃষ্টভাবে হাসি, অতিহাস্য এবং পরিহাস। নাটকের প্রেক্ষাপটে, এটি কল্পিত এবং নিন্দনীয় বিষয়ের রচনাকে বোঝায়। এবার দেখা যাক, “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ” প্রহসনে হাস্যরস কীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
“বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ” কথাটির অর্থ হলো বৃদ্ধ বয়সে যুবকের মতো বেশভূষা ও সাজসজ্জা করা। নাটকে এমন একটি দৃশ্য আছে যেখানে বৃদ্ধ ভক্তপ্রসাদবাবু যুবকের মতো পোশাক পরেছেন। গঙ্গা তাঁর সাজ দেখেই মন্তব্য করে, “ইস্! আজ বুড়োর ঠাট দেখলে হাসি পায়। শান্তিপুরে ধুতি, জামদানের মেরজাই, ঢাকাই চাদোর, জরির জুতো, আবার মাথায় তাজ!” ভক্তপ্রসাদবাবু গঙ্গাকে বলেন, “আমার হাত বাক্সটা আর আরশিখানা আনতো। দেখি একটু তার গায়ে দি (স্বগত)।” বৃদ্ধের এই সাজসজ্জা প্রবল হাসির উদ্রেক করে, কারণ এর পেছনে রয়েছে একটি গুরুতর অনৈতিক ব্যাপার এবং তার ফলেই তাঁর অপমান।
দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে ভক্তপ্রসাদের অধীরতার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায় (স্বগত), “আঃ! বেলাটা আজ কি আর ফুরাবে না, ইঃ এখনও না হবে প্রায় দুই তিন দণ্ড আছে। কী উৎপাত!” তখন তাঁর ভাবভঙ্গি, নানা অব্যয়পদের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই পুরো পরিস্থিতিটি হাস্যকর হয়ে ওঠে, কারণ এটি দীর্ঘায়িত এবং পুনরাবৃত্ত হয়। দৃশ্যের শুরুতে যেমন অধীরতা, দৃশ্যের শেষেও তা একই থাকে, সঙ্গে থাকে নিজের সাজবেশ নিয়ে তাঁর নিজের মন্তব্য। সব মিলিয়ে এই অংশটি সূক্ষ্ম হাস্যরসের উদ্রেক করে।
এরপর আরও সূক্ষ্ম হাস্যরসের উৎস হল ভক্তপ্রসাদের কাব্যরুচি। তিনি ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ থেকে কবিতার উদ্ধৃতি দেন, যা একটি প্রধান দিক। নারীর রূপ দর্শনে তাঁর “ভালো লাগে,” যেখানে একদিকে যৌনাকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট, অন্যদিকে এই আকর্ষণ থেকেই কবিতার উদ্ধৃতি দেন, যা এক ধরণের বিরোধ সৃষ্টি করে এবং সূক্ষ্ম হাস্যরসের জন্ম দেয়। ভক্তপ্রসাদের কেন্দ্র করে আরও এক হাসির উৎস হল তাঁর আচার-আচরণ, ভণ্ডামি ও মিথ্যাচারিতা। তাঁর প্রতিটি কথায় ‘রাধেকৃষ্ণ’ বা ‘দীনবন্ধু’ বলার অভ্যাসও কিছুটা হাস্যরস সৃষ্টি করে।
এই প্রহসনের শেষভাগে বিদ্রুপের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। পুঁটির মাধ্যমে বিদ্রুপ সৃষ্টি করা হয়েছে। পুঁটি নিজে অসতী ও দুশ্চরিত্রা হলেও, বারবার ফতেমার সতীত্ব নিয়ে মন্তব্য করে। ফতেমা হাসিমুখে বিদ্রুপাত্মক উত্তর দেয়, “মোরা রাঁড় হল্যি নিকা করি, তোরা ভাই কী করিস বল দেখি?” ফতেমার এই নিরীহ উত্তরে বিদ্রুপের ছায়া রয়েছে। তাছাড়া, ভক্তপ্রসাদের উক্তিতেও বিদ্রুপ ফুটে ওঠে, যা নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতি প্রযোজ্য হয়ে যায়।
এই নাটকে তিনটি স্তর স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রথমত, ভক্তপ্রসাদের উদগ্র যৌনাকাঙ্ক্ষা এবং তার থেকে উদ্ভূত স্থূল ও সূক্ষ্ম হাস্যরস। দ্বিতীয়ত, উজ্জ্বল হাস্যরস থেকে ব্যঙ্গ এবং বিদ্রুপের দিকে যাওয়া। তৃতীয়ত, সেই ব্যঙ্গের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভক্তপ্রসাদের আত্মশোধন এবং আত্মসংস্কার। যদিও এই শোধন কেবল মুহূর্তের জন্যই হয়, ভক্তপ্রসাদের মনের গভীরে যে দ্বিধা ও সংশয় কাজ করছিল, সেটাও বিবেচ্য। এই দিক থেকেই প্রহসনটির সাহিত্যিক মূল্য নির্ধারিত।
সবশেষে, প্রহসনের চরিত্রগুলো সাধারণত ধাঁচা অনুযায়ী গড়া হয়—যেখানে কোনো দ্বিধা বা বিবর্তন দেখা যায় না। ভক্তপ্রসাদ মূলত একজন ভণ্ড ও দুশ্চরিত্র চরিত্র। তবে তাঁর মধ্যে বিবেকের এক ধরনের দংশন লক্ষ্য করা যায়, যা তাঁকে নাটকীয় চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে। তবে, তাঁকে স্থূল টিপিক্যাল চরিত্র বলতেই হবে। ভক্তপ্রসাদ নিজেকে প্রথম পুরুষে উল্লেখ না করে তৃতীয় পুরুষে করেছেন, যেন এখানে দুটি ভক্তপ্রসাদ রয়েছে—একজন উল্লেখকারী এবং অন্যজন উল্লেখের উদ্দিষ্ট। যেমন, তিনি ফতেমাকে বলেন, “এততেও যদি ভক্তপ্রসাদের চেতনা হয়, তবে তার বাড়া গর্দভ আর নেই।” শেষের ছড়াটিও উল্লেখযোগ্য—“বাইরে ছিল সাধুর আকার…।”
এইসবের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, ভক্তপ্রসাদ এক ধাঁচার চরিত্র এবং এই নাটকটি সার্থক প্রহসনের মর্যাদা পেয়েছে।