শখের নাট্যশালার নবজীবন সূচিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে, আশুতোষ দেবের বাড়ির নাট্যশালায়। সেখান থেকেই প্রকৃতপক্ষে বঙ্গীয় নাট্যশালা এবং অভিনয় জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এই নাট্যশালা থেকে যে উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং অভিনয়ের গতি সঞ্চারিত হয়েছিল, তা পরবর্তী নাট্যশালাগুলোর স্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। উল্লেখযোগ্য নাট্যশালাগুলির মধ্যে বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ (১৮৫৭), বেলগাছিয়া নাট্যশালা (১৮৫৮), এবং মেট্রোপলিটন থিয়েটার (১৮৫৯) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িক শিক্ষিত সমাজের কাছে এই নাট্যশালাগুলির উদ্ভব দেশের সংস্কৃতি ও শিক্ষার উন্নতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর মাইকেল মধুসূদনকে এক পত্রে লিখেছিলেন, “এখন দেশে নাট্যশালা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে। দুঃখের বিষয়, এগুলি বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তবুও এগুলিকে সুলক্ষণ হিসেবে গণ্য করা উচিত, কারণ এর মাধ্যমে বুঝা যায় যে আমাদের মধ্যে নাটকের প্রতি রুচির প্রসার ঘটছে।” মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর সমকালীন শিক্ষার উন্নয়ন ও সংস্কৃতির বিকাশে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন।
মেট্রোপলিটন থিয়েটারের পরপরই, ১৮৬৫ সালে মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর পাথুরিয়াঘাটায় তার নিজ বাড়িতে একটি নতুন নাট্যশালা স্থাপন করেন, যার নামকরণ করা হয় ‘পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়’। সমকালীন নাট্যশালা ও নাটকের অগ্রগতিতে এই নাট্যশালার অবদান ছিল অপরিসীম।
এর পূর্বে পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের আদি বাড়িতে একটি রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হয়েছিল, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যতীন্দ্রমোহনের ছোট ভাই শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। শৌরীন্দ্রমোহনের নেতৃত্বে ঐ নাট্যশালায় ১৮৫৯ এবং ১৮৬০ সালে কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ সংস্কৃত নাটকের মর্মানুবাদের অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে, এই নাট্যশালা ঐ অভিনয়ের পর বন্ধ হয়ে যায়।
পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়ে প্রথম অভিনয় অনুষ্ঠিত হয় ১৮৬৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর। নাটকটি ছিল ‘বিদ্যাসুন্দর’, যার নাট্যরূপ দিয়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন নিজেই। তিনি কাহিনীর অবান্তর এবং অশালীন অংশগুলি বর্জন করেছিলেন। একই রাতে, ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর পর রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ নামক ফার্সেরও অভিনয় হয়েছিল। এই প্রথম অভিনয়ের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায়। ঐ রাতের অনুষ্ঠানে প্রায় দুইশোর বেশি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। বাদ্যসঙ্গীতের বিশেষ আকর্ষণ ছিল এবং অভিনেতাদের অভিনয়ও ছিল খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে বিদুষকের ভূমিকায় মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং কুকীর ভূমিকায় শৌরীন্দ্রমোহনের অভিনয় দর্শকদের বেশ আনন্দ দিয়েছিল। পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়ের অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন ঘনশ্যাম বসু।
‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের দ্বিতীয়বার অভিনয় হয় ১৮৬৬ সালের ৬ জানুয়ারি, এবং একই বছর ১৫ জানুয়ারি ‘বুঝলে কিনা’ প্রহসনের অভিনয় হয়। ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর দ্বিতীয়বার অভিনয় রেওয়ার রাজার সম্মানে আয়োজিত হয়েছিল এবং এই অনুষ্ঠানের বিবরণ ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ বিবরণে স্ত্রী-চরিত্রের ভূমিকায় নারী অভিনেতার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল। ‘বুঝলে কিনা’ প্রহসনটি ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে, এবং পত্রিকায় এর সাফল্যের কথা প্রকাশিত হয়, যেখানে দর্শকদের হাসির প্রতিক্রিয়া তার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
এরপর ১৮৬৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘মালতী-মাধব’ নাটকটি অভিনীত হয় এবং সেটিও বেশ কয়েকবার মঞ্চস্থ হয়েছিল। ১৮৭০ সালের শুরুতে তর্করত্নের ‘চক্ষুদান’ এবং ‘উভয় সঙ্কট’ প্রহসন দুটি অভিনীত হয়। তবে ১৮৭১ সালে কোন অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৮৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি রামনারায়ণের পৌরাণিক নাটক ‘রুক্মিণীহরণ’ এবং ‘উভয় সঙ্কট’ প্রহসন মঞ্চস্থ হয়। এরপরে, ১০ ফেব্রুয়ারি এবং ৫ মার্চ ‘রুক্মিণীহরণ’-এর আরও দুইবার অভিনয় হয়েছিল।
১৮৭৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গভর্নর লর্ড নর্থব্রুক পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়িতে এসেছিলেন। তার সম্মানে সেই রাতেই ‘রুক্মিণীহরণ’ এবং ‘উভয় সঙ্কট’ নাটক দুটি অভিনীত হয়েছিল। গভর্নরের সঙ্গে বহু সম্ভ্রান্ত ইংরেজ দর্শকও উপস্থিত ছিলেন। ইংরেজি দর্শকদের সুবিধার জন্য নাটকের সারাংশ ইংরেজিতে বিতরণ করা হয়েছিল। গভর্নর এই অভিনয়ের প্রশংসা করেছিলেন এবং গৃহস্বামীকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। এই অভিনয়ই ছিল পাথুরিয়াঘাটা নাট্যশালার শেষ মঞ্চায়ন। ১৮৭২ সালে সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপনের পথে পাথুরিয়াঘাটা রঙ্গনাট্যালয়ের অবদান ছিল অপরিসীম।