এই কথাগুলি বলেছেন প্রতাপ। উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে “বজ্রাঘাত” অংশে এই বিষয়টি অভিব্যক্ত হয়েছে। প্রতাপ এই কথাগুলি পাপিষ্ঠা শৈবালিনীকে বলেছিলেন।
শৈবালিনীকে ফষ্টরের নৌকা থেকে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে উদ্ধার করার পর, প্রতাপ তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে কিছুক্ষণ ঘুমন্ত শৈবালিনীর দিকে তাকিয়ে পূর্বের স্মৃতিতে বিহ্বল হয়ে পড়েন। তবে শৈবালিনী জেগে ওঠার পর, প্রতাপ তাকে ঘৃণাভরে বলতে থাকেন, “তোমার মতো পাপীষ্ঠার মুখ দর্শন করিতে নাই।” শৈবালিনী এতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি প্রতাপকে বলেন, “যদি স্লেচ্ছের ঘরে থাকা আমার এত দুর্ভাগ্য মনে করিয়াছিলে, তবে আমাকে সেইখানে মারিয়া ফেলিলে না কেন? তোমার হাতে তো বন্দুক ছিল।” এই কথার উত্তরে প্রতাপ উক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। অর্থাৎ, তিনি ইচ্ছা করলে শৈবালিনীকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি, কেবলমাত্র স্ত্রীহত্যার ভয়ে।
প্রতাপ আসলে শৈবালিনীর মৃত্যুকামনা করেছিলেন তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে। শৈবালিনী, যাকে প্রতাপ ভালোবেসেছিলেন, সামাজিক বাধার কারণে তাঁদের বিবাহ সম্ভব হবে না জেনে প্রতাপ শৈবালিনীর সাথে একসাথে মরতে চেয়েছিলেন। প্রতাপ ডুবে গিয়েছিলেন, কিন্তু শৈবালিনী জীবনের টানে ফিরে এসে প্রতাপকে ছেড়ে চলে যান। পরে, চন্দ্রশেখরের মতো একজন স্বামী পেয়েও শৈবালিনী তার আসক্তির কারণে ফষ্টরের সঙ্গে কুলত্যাগিনী হয়েছিলেন। শৈবালিনী দ্বিচারিণী এবং কলঙ্কিনী ছিলেন, এবং কলঙ্কিনী নারীর সমাজে ঠাঁই নেই। তাই প্রতাপ মনে করেছিলেন, শৈবালিনীর মরাই ভালো। অর্থাৎ শৈবালিনীর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তিনি তার জন্য মৃত্যুকামনা করেছিলেন।
উপন্যাসের উপক্রমণিকা অংশে দেখা যায়, প্রতাপের মতো প্রেমিক দ্বিতীয় কেউ নেই। তার মতো গভীরভাবে কেউ ভালোবাসতে পারে না। তিনি ভালোবাসার জন্য সব ভুলতে পারেন, কিন্তু ভালোবাসার জন্য ভালোবাসাকেই ভুলতে পারেন না। যখন তিনি নিশ্চিতভাবে জানলেন যে, শৈবালিনীর সঙ্গে তার বিবাহ সম্ভব নয়, তখন তাঁরা উভয়েই তাদের প্রেমের মর্যাদা দিতে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেন। প্রতাপ সত্যিকার অর্থে মৃত্যুর জন্য ডুবেছিলেন, তবে চন্দ্রশেখরের সাহায্যে বেঁচে যান। কিন্তু উপন্যাসের শেষাংশে, প্রতাপ এই ভালোবাসার জন্যই স্বেচ্ছায় রণক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছিলেন। মৃত্যুর প্রাক মুহূর্তে তিনি রমানন্দ স্বামীকে বলে গিয়েছিলেন, “আমার ভালোবাসার নাম আকাঙ্ক্ষা।” এই সময়ও চন্দ্রশেখর প্রতাপকে থামাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতাপ মৃত্যুর পথে অবিচল ছিলেন। এমনকি যদি দেবতাও তাকে থামাতে আসতেন, তিনি তবু বাধা ভেঙে চলে যেতেন। কারণ শৈবালিনী একান্তে তাকে জানিয়েছিলেন, “তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই।” শৈবালিনীর সুখের জন্য প্রতাপ সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাই তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নেন, শৈবালিনীর আগামী জীবনকে সুখময় করতে।
প্রতাপ, যিনি তার প্রেম ও ভালোবাসাকে এতটা মর্যাদা দেন, তিনি কি তার প্রেমিকার বিপদে নির্লিপ্ত থাকতে পারেন? যখন সুন্দরীর কাছ থেকে শুনলেন যে লরেন্স ফষ্টর শৈবালিনীকে অপহরণ করেছে, তখন তিনি জীবনের পরোয়া না করে শৈবালিনীকে উদ্ধার করতে ছুটে যান। ইংরেজ সৈন্যদের কৌশলে পরাস্ত করে শৈবালিনীকে উদ্ধার করতে তিনি সক্ষম হন। তবে প্রতাপ অন্তরে জানতেন, শৈবালিনীর মতো কামনাময়ী নারী কখনোই জোরপূর্বক অপহূতা হতে পারে না। শৈবালিনী ইচ্ছাকৃতভাবেই ফষ্টরের সঙ্গে গিয়েছেন—এ কথা প্রতাপ তার অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন। কারণ তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন, যখন তাদের বিবাহের সম্ভাবনা ফুরিয়ে গিয়েছিল, প্রতাপ সত্যিই ডুবেছিলেন, কিন্তু শৈবালিনী জীবনের আকর্ষণে ফিরে এসেছিলেন। এত বড় অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও, প্রতাপ শৈবালিনীকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন, সেই ভালোবাসায় কোন কলঙ্ক ছিল না।
সব মিলিয়ে উপন্যাসের এই অংশে প্রতাপের চরিত্র সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো—তিনি একজন সৎ, চরিত্রবান, নির্ভীক ব্যক্তি। তিনি নিজের ভালোবাসাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে জানেন, প্রিয়জনের বিপদে নিজের জীবন পণ করতেও দ্বিধা করেন না। শৈবালিনী তার প্রেমিকা হলেও, তার অবাধ্যতা এবং দ্বিচারিতার জন্য প্রতাপ ঘৃণা করতে দ্বিধা করেননি। এমনকি চারিত্রিক দৃঢ়তায় তিনি শৈবালিনীর মৃত্যুকামনাও করেছেন। শৈবালিনীর পাপের প্রতিকার করতে তিনি তাকে গুলি করে মারতে চেয়েছিলেন, কিন্তু করেননি কেবল স্ত্রীহত্যার ভয়ে। ফলে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রতাপ ছিলেন একজন সাহসী, নির্ভীক বীরপুরুষ।