তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে বাঙালির সাধারণ প্রাত্যহিক জীবনকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখে গেছেন, যা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য থেকে ভিন্ন। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলো সাধারণত রোমান্স এবং অতিমাত্রায় কাল্পনিক ঘটনায় ভরপুর ছিল, যেখানে তারকনাথ বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের বাস্তব সমস্যার প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। তার উপন্যাস “স্বর্ণলতা” (১৮৭৪) বাঙালির পারিবারিক জীবনের নিত্যদিনের টানাপোড়েন এবং ছোট-বড় সুখ-দুঃখকে কেন্দ্র করে রচিত। উপন্যাসটিতে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন, যা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা করেছে।
“স্বর্ণলতা” উপন্যাসের সাফল্য তারকনাথকে আরও উপন্যাস লিখতে উদ্বুদ্ধ করে, কিন্তু বাকি উপন্যাসগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। উপন্যাসটির গঠন সম্পর্কে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন যে এটি তিনটি প্রধান আকর্ষণীয় বিষয়বস্তুকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে: পারিবারিক জীবনের দাম্পত্য ও ভ্রাতৃবিরোধ, পথিক জীবনের অভিজ্ঞতা, এবং নৈতিক পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য পাপের শাস্তি। যদিও তারকনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের বিপরীতে নিজের সাহিত্যকর্মে রোমান্টিকতা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তার লেখাতেও কিছু রোমান্স এবং দৈবসংঘটন লক্ষ্য করা যায়, যেমন স্বর্ণলতা ও গোপালের আকস্মিক পরিচয় ও প্রেম।
“স্বর্ণলতা”-র একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর বাস্তব জীবনের সমস্যা এবং সাধারণ মানুষের চরিত্রায়ন। তারকনাথের ভাষাও ছিল সরল, প্রাঞ্জল এবং বিষয়ের উপযোগী। যদিও এতে বঙ্কিমচন্দ্রের মত ভাষার কাব্যময়তা ছিল না, তবুও উপন্যাসটি তৎকালে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বিশেষ করে উপন্যাসে সরলা, শশিভূষণ, প্রমদা, বিধুভূষণ, এবং দাসী শ্যামার চরিত্রগুলি বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিত্রিত হয়েছে, যা পাঠকদের কাছে জীবন্ত ও বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে।
সাধারণ চরিত্রগুলির জীবনের ছোট-বড় ঘটনা এবং তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার চিত্রায়ণ বাংলা গার্হস্থ্য উপন্যাসের এক নতুন ধারা তৈরি করেছে, যার পথিকৃৎ বলা হয় তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে।