Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে জসীমউদ্দিনের অবদান ও সার্থকতা মূল্যায়ন কর

বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিভিন্ন যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বিংশ শতকের মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি, মন ও মূল্যবোধকে যে বিপুল পরিবর্তনের মুখোমুখি করেছে, তার ফলস্বরূপ আধুনিক কবিতা জটিল, গূঢ়চারী এবং দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। এক ধরনের হতাশা, ক্লান্তি কিংবা কখনো নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক কবিদের মধ্যে একটি সাধারণ লক্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহজ দৃষ্টি, ঋজু প্রত্যয় এবং প্রকৃতিকে অপার মুগ্ধতায় দেখার সরল চোখ আধুনিক কবিদের মধ্যে একেবারেই অনুপস্থিত। বিশেষত ভাব ও ভাবনায় এক ধরনের তীব্র নাগরিকতা আধুনিক কবিদের পল্লী-প্রধান বাংলার রূপ ও রস সম্পর্কে উদাসীন করে তুলেছে। বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতিতে আধুনিক যুগপর্বে যে কজন ব্যক্তিত্ব বঙ্গ-প্রকৃতির রূপমুগ্ধতাকে অকুষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন যামিনী রায়, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ এবং জসীমউদ্দিন। একথা বলা যায় যে, অন্য তিন কবি-শিল্পীর মধ্যে নাগরিকতার স্পর্শ পাওয়া গেলেও, জসীমউদ্দিনের গ্রাম বাংলার প্রকৃতি-প্রেম একেবারেই সরল এবং অকৃত্রিম।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সারা বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলার কাব্য-জগতে জসীমউদ্দিন (১৯০৩-৭১) পদার্পণ করেন। শুধু গ্রামের কথা বলা, গ্রামের চিত্র আঁকা, এবং গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখকথা যে কারো কাব্যে এযুগে সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় না। গ্রামের পটচিত্রকে যামিনী রায় সাঙ্গিক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তাঁর নাগরিক মন নিয়ে, অথবা জীবনানন্দের পল্লী-প্রিয়তার পিছনে যেমন ছিল জটিল বিদগ্ধ এক মননশীল আধুনিক মন, তেমন মননশীলতা নিয়ে পল্লী প্রকৃতিকে ছুঁতে পেরেছেন কজনই বা। এই নগর-কেন্দ্রিক আধুনিক জটিল মানসিক সৃষ্টি বাংলা কবিতার জগতে জসীমউদ্দিন নিয়ে এলেন নিখাদ মেঠো সুরের রাখালিয়া গান। একদিকে রাবীন্দ্রিক ভাবগম্ভীর কাব্যচ্যুতি, অন্যদিকে আধুনিক কবিদের দুর্বোধ্য জটিল কাব্য-প্রকরণের মাঝখানে রাখালিয়া সুরের আন্তরিক ও অকৃত্রিমতায় স্বভাবতই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন জসীমউদ্দিন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জসীমউদ্দিনের কবিতার রসাস্বাদনে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘জসীমউদ্দিনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত হৃদয় এই লেখকের আছে।’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার দীনেশচন্দ্র সেনও লিখেছিলেন, ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যখানি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। এখন সেই পুরাতন পল্লীকে ফিরে পেয়েছি…এই হারানো জিনিস নতুন করে পাওয়ার যে আনন্দ, কবি জসীমউদ্দিন আমাদেরকে তা দিয়েছেন।

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে জসীমউদ্দিনের জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পাশ করেন ১৯৩১ সালে। একসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের কবিতাপ্রেমী মানুষের কাছে সমভাবে শ্রদ্ধা লাভ করেছেন জসীমউদ্দিন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল— ‘রাখালী’ (১৯২৭), ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ (১৯২৮), ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৪), ‘বালুচর’ (১৯৩২), ‘ধানখেত’ (১৯৩৯), ‘রঙিলা নায়েব মাঝি’ (১৯৪৬), ‘মা যে জননী কান্দে’, ‘জলের লিখন’, ‘পদ্মাপার’, ‘মাটির কান্না’, ‘হলুদ বরণী’, ‘সাকিনা’, ‘পল্লীবধূ’, ‘এক পয়সার বাঁশি’, ‘গাঙের পার’, ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ (১৯৭২), ‘মাগো জ্বালিয়ে রাখিস আলো’ (১৯৭৪)।

গ্রাম বাংলার রূপকল্প জসীমউদ্দিনের কাব্যে অপরূপ রূপ নিয়েছে। বাংলা তাঁর কাছে অখণ্ড, ভেদচিহ্নহীন। তিনি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দুইবার সীমান্ত মানি না। দেশের, মনের, ধর্মের, হৃদয়ের সমস্ত সীমান্ত অতিক্রম করে প্রাণের সাহিত্য সকল মানুষের একান্ত আপনার হয়।’

যথার্থই বাংলার প্রাণ অখণ্ড মূর্তি নিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছিল জসীমউদ্দিনের ব্যক্তিত্বে ও কাব্যে। তিনি মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর প্রতীক। তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গ থেকে মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর তীরের ভালবাসার সুর ও কথার প্রতীক হিসেবে এখানে এসেছি। এসেছি বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে কিছু দেওয়া নেওয়া করতে।’

তাঁর এই ভালোবাসা শুধু কবিতার ভাষায় প্রকাশিত নয়। কর্মজীবনেও তিনি সক্রিয়ভাবে বাংলার প্রতি এই ভালোবাসাকে প্রকাশ করেছেন ময়মনসিংহ গীতিকা, লোকগীতি, নকসী কাঁথা, হাতে গড়া পুতুল সংগ্রহের মাধ্যমে। তিনি নিজেই দীনেশচন্দ্র ও অবনীন্দ্রনাথকে গুরু বলে স্বীকার করেছেন। মধুর, স্নিগ্ধ, স্বচ্ছন্দভাবে গ্রাম-বাংলা তাঁর কবিতায় প্রতিবিম্বিত। আমাদের স্বপ্নময় সবুজ বাংলার শ্যামলী রূপকে খুঁজে পেতে হলে অবগাহন করতে হবে জসীমউদ্দিনের কবিতায়। নক্সী কাঁথার মাঠ বা ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে ধানের শীষ, টিয়া, ফুলবন, দূর্বাঘাস, লাউলতা, বটগাছ, তেপান্তরের মাঠ যেন আমাদের নাগরিক কৃত্রিমতায় এক মধুর স্বপ্ন রচনা করে দেয়। রূপকথার রাজ্য হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে মধুমালা। অথবা অন্ত্যজ বেদেবেদেনীর আদিম প্রেম-বিরহ অন্যতর স্বাদ নিয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। নক্সী-কাঁথার সেই মাঠ অথবা সোজন বাদিয়ার সেই ঘাট আমাদের নিত্য হাতছানি দেয়।

নক্সী কাঁথার মাঠ বহু আলোচিত কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থটি ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত। এই কাব্যগ্রন্থের কাহিনীবস্তুর সঙ্গে পূর্ববঙ্গ গীতিকার প্রকৃতিগত ও রসগত সাদৃশ্য সুস্পষ্ট। দিগন্ত প্রসারিত মাঠের দুই প্রান্তে দুটি গ্রাম। দুই গ্রামের নায়ক-নায়িকা সাজু ও সুপুরুষ রূপার পূর্বরাগ, মিলন, তাদের সংসারের উজ্জ্বল রূপ গ্রামবাংলার পটভূমিতে সুন্দরভাবে ফুটেছে। দুই গ্রামের মধ্যে বিরোধ বাধে। পুলিশের তাড়া থেকে রূপাকে গৃহত্যাগ করতে হয়। রূপার জন্য সাজুর আক্ষেপ, পীড়া এবং অবশেষে মৃত্যুতে বিষাদকরুণ এক ট্র্যাজেডিতে কাব্যের পরিসমাপ্তি।

কিন্তু সহজ সরল পল্লীবাংলার রাখালী কবি হিসেবে যাঁরা জসীমউদ্দিনকে জানেন, তাঁরা সম্পূর্ণ জানেন না। তাঁর প্রথমদিকের কাব্যগ্রন্থগুলির জন্যই তিনি পরিচিত হয়েছেন রসিক সমাজে। আবার সেই কাব্যগ্রন্থগুলির জন্যই তিনি আধুনিক, ভাবালুতাসর্বস্ব, অতীতচারী ও বাস্তব অসচেতন কবি হিসেবে সমালোচিতও হয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জসীমউদ্দিনের কবিতার ভাষা, মেজাজ ও সুরের স্বাভাবিক বিবর্তন ঘটেছে। যৌবনে রচিত ‘রাখালী’, ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ পল্লীবাংলার রোমান্টিক চিত্র যেন ময়মনসিংহ গীতিকার রসরূপের পুনর্নির্মাণ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত যখন বাংলার পল্লীতে করাল ছায়া ফেলে, যখন দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর তাড়নায় গ্রাম উজাড় হয়ে যায়; গ্রামের কৃষক সপরিবারে যখন শহরের ফুটপাতে ভিক্ষে করে অথবা ধুঁকে ধুঁকে মরে, তখন স্বাভাবিকভাবেই কবির ভাবনায় এক নতুন চিত্র উঠে আসে। পল্লীর গতি পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু জসীমউদ্দিন নিজের ভাষা, সুর ও ভঙ্গিতে নতুনভাবে মূর্তিমান করে তুলে খুঁজে পেয়েছেন বাংলার নতুন চিত্র। তিনি তাঁর ভাষার ‘স্বভাসে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি-চিত্রে রঙিন ছবি অঙ্কন করেছেন’। ‘মাটির কান্না’ (১৯৫৫) কাব্যগ্রন্থে গ্রাম-বাংলার অকৃত্রিম রূপের পাশাপাশি কলোনিয়াল শাসনের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী সুর ও সমাজের নানা সংকট, দ্রব্যদাসত্বের ছবি বিধৃত হয়েছে।

জসীমউদ্দিনের কবিতা জীবনযাপন ও জীবনদর্শনের অভ্যস্ত এক সৌন্দর্য, নান্দনিকতা, নির্মলতা ও স্বভাসের প্রাপ্তি ঘটায়। তাঁর কাব্যগ্রন্থে বাংলার প্রকৃতির বিশুদ্ধ রূপ যেমন ধরা পড়েছে, তেমনি গ্রাম-বাংলার অন্তর্গত সমকালীন সমস্যা ও সংকটও চিত্রিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হিসেবে সুকণ্ঠ, তীর্থভূমি, রূপ-রস, রাজভূমি, দুর্বহ, কঠিন, জটিল আধুনিকের মূল্য দেন। কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন জসীমউদ্দিনের কবিতা ও ভাষার মধ্যেও এক নতুন ধরনের স্বাভাবিক সহজ সরল গরিমা রয়েছে। জসীমউদ্দিনের কবিতা এক স্বর্ণালি প্রেমের বিশ্ব প্রবর্তিত করে এবং সেই সাথে একটি নিরব কবিতার ফেনিল কাব্য সুর পেয়ে যায়।

উত্তরাধিকারমূলক কাব্য রীতির পুনর্বিন্যাসে জসীমউদ্দিন সমকালীন সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি নতুন ভাবমূর্তি রচনা করেছেন। বাংলা কাব্য রীতির ক্ষেত্রে এমনভাবেই নতুন একটি লাহি স্বর ও তীব্রতা এনে দিয়েছেন। তাঁর পরবর্তীকালে প্রাতিষ্ঠানিক ধারা ছেড়ে দিয়ে গ্রামবাংলার ঋজুতা, সহজাত প্রাকৃতিক লাবণ্য ও অকৃত্রিম প্রকৃতি নিয়ে বাংলা কবিতার ভাষা এক নতুনত্বে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে।

এবং এই নবপ্রবর্তিত বাংলা কবিতার ভাষা ও ভাবনার ইতিবাচক মিশেল হিসেবে জসীমউদ্দিনের ভাবনা, বক্তব্য ও ভাবনাচেতনার বৈশিষ্ট্য আমাদের স্মরণ করতে হয়। তার ভেতরে একবিংশ শতকের বাংলার প্রকৃতি, গ্রামের মানুষের নির্ভীক সংগ্রাম এবং অধিকার আদায়ের কবিতা হয়ে উঠেছে—এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। জসীমউদ্দিনের কবিতার সৌন্দর্য, অনুভব এবং সহজ ভাবনা বাংলা কবিতার ঐতিহ্যিক ধারাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে এবং কবিতার শিল্পকলাকে অতি প্রাকৃত, অকৃত্রিমরূপে মূর্তমান করেছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.