সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিত্বের বিশেষত্ব এবং রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সম্পর্কে আপনার পর্যালোচনা খুবই চিত্তাকর্ষক। সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যরচনায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব স্বীকৃত হলেও, তার নিজস্ব শৈলী এবং কবি-প্রকৃতির বৈচিত্র্য তাকে আলাদা পরিচয় এনে দিয়েছে। তার কবিতা ও গদ্যসাহিত্য রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবিদের জন্যও প্রেরণার উৎস ছিল।
যদি আপনি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সাহিত্যকর্মের এই বৈচিত্র্য এবং প্রভাব নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করতে চান, তবে তার প্রভাবিত কাব্যসত্তা এবং স্বতন্ত্র কাব্যভাষার তুলনামূলক বিশ্লেষণ আপনার কাজকে আরও গভীর করবে। এতে তার কবিতা এবং গদ্যর মধ্যে সৃষ্টিশীলতা এবং তার কাব্যিক পথের বিশেষত্ব উন্মোচিত হতে পারে।
রবীন্দ্রপ্রভায় বর্ধিত কবিদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথের জন্য বিশিষ্ট আসন রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই অনুজপ্রতিম কবির অকাল মৃত্যুতে ‘পূরবী’ কাব্যের অন্তর্গত ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’ কবিতাটি রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথের প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন –
‘জানি, তুমি প্রাণ খুলি
এ সুন্দরী ধরণীতের ভালোবেসেছিলেন। তাই তারে
সাজায়েছ দিনে দিনে নিত্য নব সংগীতের হারে।
অন্যায় অসত্য যত, যত কিছু অত্যাচার পাপ
কুটিল কুৎসিত ক্রূর, তার ‘পরে তব অভিশাপ
বর্ষিয়াছে ক্ষিপ্রবেগে অর্জুনের অগ্নিবাণসম,
তুমি সত্যবীর, তুমি সুকঠোর, নির্মল, নির্মম,
করুণ, কোমল। তুমি ব্যঙ্গ ভারতীয় তন্ত্রী পরে
একটি অপূর্ব তন্ত্র এনেছিলেন পারাবার তরে।
সে তন্ত্র হয়েছে বাঁধা; আজ হতে বাণীর উৎসবে
তোমার আপন সুরে কখনো ধ্বনিবে মন্ত্র রবে,
কখনো মঞ্জুল গুঞ্জরণে।’
রবীন্দ্র-প্রতিভা যখন মধ্য-গগনে তখন তার একদল অনুরাগী তার আদর্শে ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁকে প্রায় অন্ধভাবেই অনুসরণ করেছিলেন, আর একদল অনুরাগী রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্র প্রভাব-বর্জিত সাহিত্যই শুধু রচনা করেন নি, তারা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বতন্ত্র পথের পথিক। এঁদের মধ্যে রয়েছেন—প্রমথ চৌধুরী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মােহিতলাল মজুমদার এবং কাজী নজরুল ইসলাম। জনপ্রিয়তায় এদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামই প্রাগবর্তী বিষয়বস্তুর দিকে যেমন, তেমনি ভাষা ছন্দ এবং আঙ্গিকের দিক থেকেও এঁরা বাংলা কাব্যে অনেক বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন। বৈচিত্র্যের বিচারে সত্যেন্দ্রনাথের নামই সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়ে থাকে।
বিশিষ্ট মনীষী অধ্যাপক ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কবি সত্যেন্দ্রনাথের যে মূল্যায়ন করেছেন তা থেকেই তাঁর কাব্য-বিষয়ে মােটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “সত্যেন্দ্রনাথ শুধু কবি হিসেবেই উল্লেখযােগ্য নহেন, বাংলা কাব্যে একটা বিশিষ্ট প্রভাব-রূপেও তিনি স্মরণীয়। রবীন্দ্র-কাব্য হইতে অতি আধুনিক কাব্যের যে সুর পরিবর্তন, তাহার মূলে অনেকটা তাহারই প্রভাব। কাব্যে চলতি ভাষা ও কথাভঙ্গী, হাল্কা সুর, দেশ-বিদেশ হইতে আহৃত নানা অপরিচিত শব্দের সুষ্ঠু ও নির্ভীক প্রয়ােগ, নুতন নূতন ছন্দরীতির মাধ্যমে ভাবের সাবলীল, উল্লসিত প্রকাশ, জীবনের বহু নূতন বিভাগে, অনুভূতির বহু নূতন ক্ষেত্রে কাব্যসীমার প্রসার আধুনিক কাব্যের এই সমস্ত প্রবণতা বহুলাংশে সত্যেন্দ্রনাথের দৃষ্টান্ত প্রভাবিত।…আধুনিক কবিতার যে প্রধান লক্ষণ ভাবগভীরতার পরিবর্তে কৌতুহল বিস্তৃতি, কাব্যানুরঞ্জনের স্থলে জীবন-রসের আস্বাদন বৈচিত্র্য, স্তব্ধ ধ্যান-তন্ময়তার স্থলে গতিবেগের উন্মাদনা, প্রথাগত কাব্যরীতির পরিবর্তে সংলাপ-ভঙ্গীর দ্রুত সঞ্চারী ভাবানুগামিতাতাহা সত্যেন্দ্রনাথের কাব্য পরীক্ষা হইতেই প্রধানতঃ উদ্ভূত।”
সত্যেন্দ্রনাথের প্রতি সুবিচার যথার্থভাবে এখনও হয়নি। অনেকে তাঁকে ‘ছান্দসিক’ বলেই ক্ষাস্ত হয়েছেন আবার অনেকে উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
প্রধানতঃ কবিরূপেই বিশ্রুতকীর্তি হলেও সত্যেন্দ্রনাথ গদ্য-রচনায়ও যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ আদি বহুবিধ গদ্যধারায়ও তার প্রচেষ্টা নিয়োজিত। ছিল। বিশেষতঃ নানা জাতীয় গ্রন্থের অনুবাদ রচনায় তার সবিশেষ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। নিম্নে প্রদত্ত তালিকায় তার বিভিন্ন জাতীয় মৌলিক ও অনুবাদ রচনার সন্ধান পাওয়া যাবে। ‘সবিতা’ (১৯০০ খ্রীঃ), ‘সন্ধিক্ষণ’ (১৯০৫), ‘বেণু ও বীণা’ (১৯০৬), ‘হােমশিখা’ (১৯০৭), ‘তীর্থসলিল’ (অনুবাদ কবিতা, ১৯০৮), ‘তীর্থরেণু’ (অনুবাদ কবিতা, ১৯১০), ‘ফুলের ফসল’ (১৯১১), ‘কুহু ও কেকা’ (১৯১২), ‘জন্মদুঃখী’ (অনুবাদ উপন্যাস, ১৯১২), ‘চীনের ধূপ’ (অনুবাদ প্রবন্ধ, ১৯১২), ‘রঙ্গমন্ত্রী’ (অনুবাদ নাট্য সংগ্রহ, ১৯১৩), ‘তুলির লিখন’ (১৯১৪), ‘মণি মঞ্জুষা’ (অনুবাদ কবিতা, ১৯১৫), ‘অভ্র আবীর’ (১৯১৬), ‘হসস্তিকা’ (‘নবকুমার কবিরত্ব’ ছদ্মনামে রচিত ব্যঙ্গকবিতা, ১৯১৭), ‘বারােয়ারি উপন্যাস’ (৪টি মাত্র পরিচ্ছেদ, ১৯২১), ‘ডঙ্কানিশান’ (অসমাপ্ত উপন্যাস, ১৯২৩), ‘বেলা শেষের গান’ (১৯২৩), ‘বিদায় আরতি’ (১৯২৪), ‘ধূপের ধোঁয়ায়’ (নাটিকা, ১৯২৯)। কাব্য-ব্যতিরিক্ত সত্যেন্দ্রনাথের যে গ্রন্থটি সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেছে, সেই ছন্দ-সরস্বতী’ ১৩২৫ বঙ্গাব্দে ভারতী’ পত্রিকার বৈশাখ মাসে প্রবন্ধ আকারে প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল।
পূর্বেই বলা হয়েছে, সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যে ভাবের গভীরতা অপেক্ষা কৌতুক-কৌতূহলের পরিমাণই ছিল বেশি। এ ছাড়াও বিভিন্ন ভাষা সাহিত্যে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি থাকায় তিনি কাব্যের ভাষা ও ছন্দের পারিপাট্যসাধনে তথা বহিরঙ্গ-প্রসাধনেই ছিলেন সমধিক মনােযােগী। তাই তার কবিতাগুলি হৃদয়ের দ্বারে উপনীত হতে না পারলেও চক্ষুকর্ণের তৃপ্তি-সাধনে ছিল অতিশয় তৎপর। ফলে রসজ্ঞ পাঠকের কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হলেও সত্যেন্দ্রনাথ এক জাতীয় পাঠকের নিকট অতিশয় আদরণীয় বিবেচিত হতেন। কাব্যের বিষয়রূপে অবশ্যই কোন-না-কোন বস্তুকে গ্রহণ করতে হয়, কিন্তু প্রকৃত কবি সেই বস্তুসত্তাকে রসে পরিণত করেন, অকবির হাতে তা বস্তুপিণ্ডই থেকে যায়। ‘তাজমহল’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখেছেন, তাতে তাজমহলের কোন বস্তুধর্মের পরিচয়ই পাইনে, আবার সত্যেন্দ্রনাথের তাজ কবিতার সিংহলী নীলা রাঙা আরবী প্রবাল তিব্বতী ফিরােজা পাথর প্রভৃতির সমাহারে তাজমহলকে একটা জড়পিণ্ডের রূপ দিবার চেষ্টা করেন। দু’য়ের পার্থক্য—দিগন্তবিহারী কল্পনার পর কোমল উত্তাপে বিগলিত করে রবীন্দ্রনাথ যখন লাবণ্য করা অরূপ রতন সৃজনে ব্যস্ত, সত্যেন্দ্রনাথ তখন সেই বস্তুকে বস্তু রেখেই কয়েকটি রেখাঙ্কনের অপরিসীম কৌতূহলে মত্ত। শুধু এ জাতীয় বস্তুজগৎ এবং প্রকৃতিজগৎই নয়, স্বদেশ ও ঐতিহ্যপ্রীতি-সম্পর্কিত বিভিন্ন কবিতাতেও সত্যেন্দ্রনাথের স্থূল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কবিতা পুঞ্জীভূত তথ্যের আকার ধারণ করে। বস্তু চিরকাল বস্তুপিণ্ডই থেকে যায়, তা কখনাে রসমূর্তি পরিগ্রহ করে না।
সত্যেন্দ্রনাথ বস্তুতঃ সর্বাধিক কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন বিচিত্র ছন্দ-রচনায়। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথই প্রথম তিন জাতীয় ছন্দকে সার্থকভাবে ব্যবহার করলেও সত্যেন্দ্রনাথ তার সীমাকে আরও প্রসারিত করেন। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের মধ্যে যত প্রকার বৈচিত্র্য সম্ভবপর, সত্যেন্দ্রনাথ তা সবই সৃষ্টি করেছেন। ইংরেজি, জাপানী, আরবী, ফারসী ভাষার বিচিত্র-ছন্দকেও তিনি একই কাঠামােতে এনে দাঁড় করিয়েছেন এবং তাতে এদের স্বরূপ-বৈশিষ্ট্যও অক্ষুন্ন রয়েছে। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র ও তার অনুকরণে অপর কেউ কেউ কোন কোন সংস্কৃত ছন্দ ব্যবহার করেছেন বাংলা ভাষায় এবং সংস্কৃত নিয়মে বাংলা দীর্ঘস্বরে দুই মাত্রা ব্যবহার করেছেন যা বাংলা উচ্চারণ প্রকৃতির একান্ত বিরােধী। সত্যেন্দ্রনাথ মন্দাক্রান্তা, মালিনী আদি সংস্কৃত ছন্দকে অতিশয় সার্থকভাবেই বাংলায় ব্যবহার করেছেন উচ্চারণ প্রকৃতি অক্ষুন্ন রেখেই। তার ‘ছন্দ-সরস্বতী’ নামক গ্রন্থটি কাব্যমণ্ডিত ভাষায় রূপক-আকারে রচিত হলেও বাংলা ছন্দের যথাযথ বিজ্ঞানসম্মত শ্রেণীবিভাগ তাতেই সর্বপ্রথম প্রদর্শিত হয়েছে। ছন্দ-বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথের অসাধারণ দক্ষতার জন্যই রবীন্দ্রনাথ তাকে ‘ছন্দের যাদুকর’ আখ্যায় ভূষিত করেছিলেন।
সত্যেন্দ্রনাথের অপর বিশেষ কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে শব্দ-নির্বাচনে। এই বিষয়ে তিনি ভারতচন্দ্র-পন্থী—যে হােক সে হােক ভাষা কাব্য রস লয়ে। যথাযথ পরিবেশ এবং উপযুক্ত রস- সৃষ্টির জন্য তিনি নির্বিচারে যেমন দেশি কিংবা বিদেশি আরবী, ফারসী, শব্দ ব্যবহার করেছেন, তেমনি অপ্রচলিত তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারেও অকুণ্ঠ ছিলেন।
বিদেশি শব্দ এবং ছন্দ ব্যবহারে সত্যেন্দ্রনাথ যেমন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, আরবী, মিশরীয়, ফারসী, চীনা, জাপানী বা ইংরেজী কবিতার অনুবাদে এবং অনেক সময় মূল কবিতার ছন্দের অনুবর্তনেও অনুরূপ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ “…তােমার এই লেখাগুলি মূলকে বৃত্তস্বরূপ আশ্রয় করিয়া স্বকীয় রসসৌন্দর্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে। আমার বিশ্বাস কাব্যানুবাদের বিশেষ গৌরব তাই—তাহা একই কালে অনুবাদ ও নূতন কাব্য।” অনুবাদের এর চেয়ে বড় প্রশংসা আর কি হতে পারে!