বাংলাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা চিহ্নিত করা যায়, তবে প্রকৃতপক্ষে আধুনিকতার সঠিক সুর বাংলা সাহিত্যে অনেক পরে প্রবেশ করে। যুগবিভাগের সুবিধার্থে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই এই যুগের নামকরণ করা হয়েছে, যদিও এর রচনাশৈলী, বৈশিষ্ট্য, এবং গতি-প্রকৃতিতে নতুন ভাবপ্রকাশ ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পরপরই দেখা দিতে শুরু করে। যদিও ১৭৬০ সালে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর সাথে মধ্যযুগের সমাপ্তি ধরা হয়, এরপর প্রায় অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে নতুন সৃষ্টির ধারা গড়ে ওঠেনি।
তবে ১৮৫৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর থেকেই আধুনিক যুগের সূচনা ধরা হলেও, এর প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে থেকেই বাংলা সাহিত্যে নতুন একটি সুরের আভাস পাওয়া যায়, এবং এই প্রভাব থেকে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও মুক্ত ছিলেন না। তিনি তাঁর কবিতায় বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে নতুনের পদচিহ্নকে মেনে নিয়েছিলেন। সুতরাং ১৭৬০ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে নতুন ও পুরাতনের একটি মিশ্র ধারা প্রবাহিত হয়েছিল, যা ‘যুগসন্ধি কাল’ নামে অভিহিত করা হয়। তাই প্রকৃত আধুনিক যুগের সূচনা বলতে হলে উনিশ শতকের প্রথমদিক থেকেই ধরতে হয়, এবং ১৮০০ সালকে তার প্রারম্ভিক সময় বলা যায়। বিশেষত, এই বছরেই শ্রীরামপুরে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন এবং কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা সরাসরি পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসি, এবং বাংলা সাহিত্যে গদ্যসাহিত্যের সৃষ্টির প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিছু সমালোচক উনিশ শতকের প্রথমার্ধকে (১৮৫৮ সাল পর্যন্ত) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গঠনমূলক যুগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এই আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্য নবজাগ্রত বাঙালি মননের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রকাশিত হয়, যা নতুন জীবনবোধের এক ঐশ্বর্যময় দিগন্ত উন্মোচিত করে। সকল ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের একটি তরঙ্গ বাঙালির ভাবচেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, এবং তার ফলস্বরূপ মধ্যযুগের দেবতাকেন্দ্রিক সাহিত্যকে পেছনে ফেলে নতুন রূপ ও আঙ্গিকের মাধ্যমে এক বিস্ময়কর সৃষ্টির যুগ শুরু হয়। ধর্মীয় চেতনার মধ্যে যুক্তিবাদ ও মানবতাবোধের উদয় হয়। বাঙালির চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ এসে দাঁড়ায়, এবং কবি মধুসূদনের কাব্যজগতে রামচন্দ্র ভগবানের অবতার হিসেবে অবজ্ঞাত হন। তাঁর অনুসরণে কবি হেমচন্দ্রও প্রাচীন পটভূমিকায় নতুন যুক্তিবাদী চিন্তা মিশিয়ে আখ্যানকাব্যকে নতুন রূপ দেন।
এই সময়ে সামাজিক বাস্তবতাবোধ থেকে উপন্যাস ও ছোটগল্পের জন্ম হয়। তবে এর আগেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের সহায়তায় উইলিয়াম কেরি বাংলা গদ্যের একটি কাঠামো গড়ে তোলেন, এবং রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় এই নবসৃষ্ট গদ্য সাহিত্যের দ্রুত বিকাশ ঘটে। মধ্যযুগে সাহিত্যচিন্তায় গৌণ স্থান পাওয়া প্রকৃতি তখন জীবনচিন্তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সাহিত্য সৃষ্টির একটি মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। জীবন ও জগতের সাথে জীবনাতীত পরমশক্তিকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার স্পৃহা জন্ম নেয়, এবং এর মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের নতুন অধ্যায় রচনার অনুপ্রেরণা আসে।
পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের কারণে মঙ্গলকাব্য ও পদাবলীর ধারাকে অতিক্রম করে মহাকাব্যের নতুন আঙ্গিকে সৃষ্টি হয়, এবং ব্যক্তিগত হৃদয়ের ভাবপ্রকাশ গীতিময় করে গীতিকবিতার আবির্ভাব ঘটে। বিহারীলাল চক্রবর্তী বাংলা কবিতায় গীতিকবিতার স্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন, এবং মধুসূদন কেবল এর ভূমিকা রচনা করেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মধুসূদন চতুর্দশপদী বা সনেটের প্রচলন করেন, যা সাহিত্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নতুন সুর হিসেবে প্রতিধ্বনিত হয়।
এই যুগের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল সাহিত্যে জাতীয়তাবাদের উদয়। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় এই জাতীয়তাবাদের সূচনা ঘটে, এবং তিনিই প্রথম বিদেশের ঠাকুর ফেলে স্বদেশের কুকুরকে আদরের জন্য আহ্বান জানান। রঙ্গলালের ‘পদ্মিনী-উপাখ্যান’-এ স্বাধীনতাহীনতার ব্যথা প্রকাশ করে আত্মত্যাগের আহ্বান ধ্বনিত হয়। মধুসূদনের কাব্যেও জাতীয়তাবোধের সূক্ষ্ম ধ্বনি শোনা যায়। হেমচন্দ্র ‘জাতীয়তাবোধের কবি’ হিসেবে পরিচিত হন, এবং নবীনচন্দ্রের কবিতাতেও জাতীয়তাবাদের অনুভূতি সুন্দরভাবে প্রকাশ পায়। সবচেয়ে ব্যাপকভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনা বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য—প্রবন্ধ, উপন্যাস, এবং সাংবাদিকতায় প্রকাশিত হয়।
এই যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য গদ্যসাহিত্যের উদ্ভব। এর মাধ্যমে বাঙালির ভাবনা ও মননের এক অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়। এই গদ্যের মাধ্যমে তৎকালীন চিন্তানায়করা সমস্ত সৃষ্টিকর্ম ও দেশের গঠনকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। গদ্যসাহিত্যের বিকাশের সঙ্গে সাময়িকপত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চিন্তাধারাকে ছড়িয়ে দেয়। এর মাধ্যমে নতুন জ্ঞানার্জনের স্পৃহা উজ্জীবিত হয়, এবং নতুন যুগের সমস্ত সাহিত্যে পূর্ণতা আনার প্রচেষ্টা করা হয়। পাঠকের রসপিপাসা মেটানোর জন্য উপন্যাস ও গল্পসাহিত্যের উদ্ভব হয়, এবং গদ্যের মাধ্যমে মননশীল প্রবন্ধেরও সৃষ্টির পথ তৈরি হয়, যা বাংলা এবং বাঙালির চিন্তার জগতকে প্রসারিত করে।
ক্রমশ ইংরেজি সাহিত্য ও ভাবধারার নিবিড় সংস্পর্শে এসে বাঙালিরা ইউরোপীয় ধরনের নাট্যরঙ্গমঞ্চ তৈরি করার প্রয়াস পান, এবং নাটক রচনারও প্রেরণা পান। বাংলা নাট্যসাহিত্যের উদ্ভব হয়, এবং এর অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পেশাদারী রঙ্গমঞ্চও প্রতিষ্ঠিত হয়। আধুনিক যুগের বাংলা নাটকে ইউরোপীয় সাহিত্যের অনুকরণে ট্র্যাজেডির প্রবর্তন ঘটে, যা প্রাচীন বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যে ছিল না।