চন্ডীর বহু নামের মধ্যে একটি হলো ‘অন্নদা’। মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র এ নামেই তাঁর বিখ্যাত কাব্য অন্নদামঙ্গল রচনা করেছেন। অবশ্য এটিকে কেউ কেউ মঙ্গলকাব্য বলতে চান না। এর কারণ মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে এর
পার্থক্য নানা দিক থেকে। যেমন, চন্ডীমঙ্গলের চন্ডীর যে চন্ডমূর্তি, অন্নদামঙ্গলে তা দেখা যায় না। এখানে তিনি অভয়া, বরদা ও অন্নপূর্ণারূপে যেন একজন স্নেহময়ী বঙ্গজননী। অন্যান্য চন্ডীমঙ্গলে পূজা পাওয়ার জন্য চন্ডীর যে কোপনা স্বভাব, এখানে তা নেই; এখানে তিনি দাক্ষিণ্যময়ী। হয়তো উদ্ভবের পর থেকে তিনশ বছর ধরে হিন্দুসমাজে চন্ডীর প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়েছে, তাই তাঁর মধ্যে উগ্রতা পোষণের আর প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আরেকটি বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, নতুন করে কেউ কোথাও প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চাইলে সেখানে তাকে শক্তিপ্রয়োগ করতে হয় এবং প্রতিষ্ঠালাভ সম্পন্ন হলে অধীনস্থদের সর্ব প্রকারে প্রতিপালন করতে হয়। এমনিভাবে আরও অনেক মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ভারতচন্দ্র ছিলেন আঠারো শতকের শ্রেষ্ঠ কবি এবং তাঁর অন্নদামঙ্গল এ সময়ের শ্রেষ্ঠ কাব্য। কাব্যটি তিন খন্ডে তিনটি স্বতন্ত্র কাহিনীতে পূর্ণতা লাভ করেছে। প্রথম খন্ডে শিবায়ন-অন্নদামঙ্গল, দ্বিতীয় খন্ডে বিদ্যাসুন্দর-কালিকামঙ্গল এবং তৃতীয় খন্ডে মানসিংহ-অন্নপূর্ণামঙ্গল কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। প্রথম উপাখ্যানের মূল ঘটনা পৌরাণিক। এতে সতীর দেহত্যাগ, পার্বতীর বিবাহ, শিবের সংসার ও কাশীতে দেবীর অন্নপূর্ণামূর্তি ধারণের বর্ণনা আছে। সেসঙ্গে যুক্ত হয়েছে হরিহোড়কে ছেড়ে দেবী কিভাবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দের পিতৃগৃহে উপস্থিত হন সেই লৌকিক কাহিনী। দ্বিতীয়টি বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী। কালিকার কৃপায় কিভাবে সুন্দর বিদ্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন এবং মশান থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন সে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এখানে। তৃতীয় অংশটি অনেকটা ঐতিহাসিক। মানসিংহ কর্তৃক প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত ও বন্দিকরণ এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের নিকট থেকে ভবানন্দের ‘রাজা-ই-ফরমান’ লাভের ঘটনা এখানে বর্ণিত হয়েছে।
অন্নদামঙ্গল থেকে তৎকালীন বাঙালি সমাজের অনেক তথ্যই পাওয়া যায়। দেবী ও ঈশ্বরী পাটনীর ঘটনা থেকে দেব- মানুষের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানা যায়। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ দেবীর নিকট পাটনীর এই বর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে অনুমান করা যায় যে, তখন ন্যূনপক্ষে দুধভাত খাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল বাঙালি জীবন-যাত্রার নিম্নতম স্ট্যান্ডার্ড। অন্নদামঙ্গলে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো এতে দৈবপ্রাধান্য কম, সে স্থান দখল করেছে মানুষ। এখানে দেবীর সন্তুষ্টিকামনা অপেক্ষা রাজার সন্তুষ্টিকামনা তীব্রতর। মূলত নদীয়ার রাজবংশের গৌরবময় ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে কবি সমকালীন ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে দৈব ঘটনা মিশিয়ে নগরসংস্কৃতিসুলভ একটি আদিরসাত্মক প্রণয়োপাখ্যান রচনা করেছেন। এর সাহিত্যিক মূল্যও অসাধারণ। উপমাদি অলঙ্কার এবং ছন্দ প্রয়োগে তিনি যে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তাতে তাঁর মৌলিকত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
মঙ্গলকাব্য কী? মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ও সময়কাল, মঙ্গলকাব্য রচনার সামাজিক প্রেক্ষাপট
মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য বা মঙ্গলকাব্যের লক্ষণ গুলো লিখ
মনসামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
অন্নদামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
শিবায়ন বা শিবমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
মনসামঙ্গল কাব্যের বিষয়বস্তু ও মনসামঙ্গল কাব্যের কবি পরিচয়
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি বিজয়গুপ্ত সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি নারায়ণদেব সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কবি বিপ্রদাস পিপলাই সম্পর্কে লিখুন
মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনী ও শিল্পমূল্য বিচার! মনসামঙ্গল কাব্যের গুরুত্ব বিচার
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সম্পর্কে লিখুন
অন্নদামঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র
অন্নদামঙ্গল কাব্যের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর সম্পর্কে লিখুন
ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট, কাহিনির সংক্ষিপ্তসার, শিল্পমূল্য বিচার ও চরিত্র