নারীবাদের বিভিন্ন তরঙ্গ ও ধারা: নারীবাদের আলোচনায় যে তরঙ্গগুলোর কথা বল হয় সেগুলো হল-
১. নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ (First Wave of Feminism):
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত যেসব নারীবাদী চিন্তা, বিশ্লেষণ, তত্ত্ব বা সমান্তরাল ভাবে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেগুলোকে সামগ্রিকভাবে নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ বলা হয়। এই তরঙ্গের নারীবাদী চিন্তা সমাজে নারী পুরুষের বৈষম্য, নারীর নিম্নতম অবস্থান, নারীর অধিকার অর্জন ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু এই তরঙ্গে নারীর যৌনতা, গর্ভপাতের অধিকার, শরীরের উপর নারীর অধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। এই তরঙ্গে যেসমস্ত নারীবাদী তাত্বিকদের গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সেগুলো হলো- মেরি উলস্টোনক্র্যাফট এর এ ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস অফ উইমেন (১৭৯২), জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘দি সাবজেকশন অফ উইমেন (১৮৬৯), ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এর দি অরিজিন অফ দি ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রোপার্টি অ্যান্ড দি স্টেট (১৮৮৪), অলিভ সাইনারের, উইম্যান অ্যান্ড লেবার (১৯১১) প্রভৃতি।
২. নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গ (Second Wave of Feminism):
শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নারীবাদী চিন্তা ভাবনার সূত্রপাত ঘটে ফরাসি দার্শনিক সিমন দ্য বোভোয়ার বিখ্যাত “The second sex” (১৯৪৯) গ্রন্থে। তিনি বলেন যে, জৈবিক নিয়মানুসারে ছেলে মেয়ের পার্থক্য খুব স্বাভাবিক কিন্তু সামাজিক প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে ছেলের পৌরুষ (Masculinity) তৈরী করে ও মেয়ের নারীত্ব (Femineity) তৈরি করে। এ প্রসঙ্গে বোভোয়া বলেছেন, One is not born but mother becomes a woman” এই চিন্তাধারা থেকে পিতৃতান্ত্রিক, জৈবিক লিঙ্গের সাথে সামাজিক লিঙ্গের পার্থক্য এই ধারণাগুলোর সূচনা করে, যা থেকে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের সূচনা হয়। এছাড়াও বেটি ফ্রাইডেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ “The Feminine Mystique (১৯৬৩) এ মূলস্রোতের সংস্কৃতি নারীকে যেভাবে উপস্থাপিত করে ভার তীব্র সমালোচনা করেন।
প্রথম তরঙ্গের তুলনায় দ্বিতীয় তরঙ্গ ছিল অনেক বেশি বৈপ্লবিক ও প্রগতিশীল, গ্রেট ব্রিটেনে দ্বিতীয় তরঙ্গে নারীবাদী আন্দোলন মূলত অর্থনৈতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। শ্রমিক নারীদের সমান মজুরীর দাবী, বিভিন্ন কারখানায় ধর্মঘট ইত্যাদি দ্বিতীয় তরঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮০র গোড়ার দিক থেকেই নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গও স্তিমিত হয়ে পড়ে।
৩. নারীবাদের তৃতীয় তরঙ্গ (Third Wave of Feminism):
তৃতীয় তরঙ্গের সূত্রপাত হয় ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে এবং ধরা হয় এখনও এ পর্যায়টি চলচে। তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদ গাত্রবর্ণ ভিত্তিক গোষ্ঠীর বিরোধীতা, উত্তর ঔপনিবেশিকতা বাদী তত্ত্ব, সমালোচনামূলক তত্ত্ব, উত্তর আধুনিকতাবাদ, পরিবেশ কেন্দ্রিক নারীবাদ, বিকল্প যৌনতার চিন্তা ইত্যাদি থেকে রসদ সংগ্রহ করে। এই তরঙ্গের একটি উল্লেখ্যযোগ্য ধারণা হল “নারীশক্তি” বা “Girls Power”.
এই তরঙ্গের প্রবক্তারা হলেন- রেবেকা ওয়াকার, ইনগার মিউসিও মনিকা দাভে প্রমুখ। এই তৃতীয় তরসেই শুরু হয় উত্তর আধুনিক, উত্তর উপনৈবিশবাদী, কৃষ্ণাঙ্গ, নারী সমকামী, মনসমীক্ষনবাদী, উত্তর অবয়বাদী ও তৃতীয় বিশ্ব কেন্দ্রিক নানা নারীবাদের উত্থান।
৪. নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গ (Fourth Wave of Feminism):
এই তরঙ্গের সূত্রপাত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই তরঙ্গের মূল বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন অধিবেশনের মাধ্যমে বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই নারীরা নিজেদের মধ্যে অত্যন্ত সক্রিয় যোগাযোগ বজায় রাখে। এই তরঙ্গেরর অন্যতম প্রবক্তা সাহিত্যিক Carol Lee flinders বলেন যে, When you get Jewish, Catholic Buddhist, Hindu and Sufi Women all practicing their faith in the same room, another religion emerges, which is feminine spirituality”
নারীবাদের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো ধারা, যে ধারাগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে এক হলেও এদের প্রত্যেকেরই আলাদা বা বিশেষ কিছু দিকে নজর ছিলো। নারীবাদের বিভিন্ন ধারাগুলো হচ্ছে:-
১) উদারতাবাদী/উদারপন্থী নারীবাদ (Liberal Feminism)
২) উগ্রপন্থী নারীবাদ (Radical Feminism)
৩) সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ (Socialist Feminism)
৪) মার্ক্সসীয় নারীবাদ (Marxist Feminism)
৫) অস্তিত্ববাদী নারীবাদ (Existential Feminism)
আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
নারীবাদের স্বরূপ ও পরিসর সংক্ষেপে আলোচনা করুন
নারীবাদ কী বা নারীবাদ কাকে বলে? নারীবাদের সংজ্ঞার্থ প্রদান করুন
নারীবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
নারীবাদের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা করুন
নারীবাদী তত্ত্ব কী? নারীবাদী তত্ত্ব কত প্রকার ও কী কী – আলোচনা করুন
নারীবাদের বিভিন্ন তরঙ্গ বা নারীবাদের ধারাগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করুন