নারীবাদ : উৎপত্তি ও বিকাশ
নারীবাদের উৎপত্তি ঘটেছিল পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার উদার ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মধ্যে। মূলত পাশ্চাত্যের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মধ্যে নারীবাদের মূল প্রেরণা প্রোথিত। এসব তত্ত্ব থেকেই ধীরে ধীরে নারীবাদী আন্দোলন ও তত্ত্ব বিকশিত হয়েছে। আমেরিকায় ১৭৭৬ সালের The Declaration of Independence এবং ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালের The Declaration of the Rights of Man and of the Citizen প্রণীত হয়। কিন্তু এ সব ঘোষণা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে গৃহীত হলেও নাগরিক হিসেবে কেবল শ্বেতাঙ্গ পুরুষরাই অধিকার লাভ করেছিল—নারীরা নাগরিক পদবাচ্য ছিল না বলে তাদের কোনো অধিকারও ছিল না। কাজেই তাদের দাবি ছিল নারীদেরকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি ও অধিকার দেওয়া। আমেরিকার The Declaration of Independence-এর প্রণেতা ও পরবর্তী প্রেসিডেন্ট John Adams-কে তাঁর স্ত্রী Abigail Adams নতুন আইনে নারীর অধিকার রক্ষার কথা বলেছিলেন: Remember the ladies in the new code of law. ফ্রান্সে পুরুষের পাশাপাশি নারী অধিকারের সপক্ষে ১৭৯০ সালে Olympe de Gouges Pre Declaration of the Rights of Woman and the Female Citizen. ১৭৯২ সালে ইংল্যান্ডে নারী অধিকারের পক্ষে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট ‘A Vindication of the Rights of Woman’ লিখেছিলেন। এ বইটি নারীবাদী চিন্তা ও আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ধারার সূচনা করেছিল।
১৮৪৮ সালে Elizabeth Cady Stanton এর নেতৃত্বে Seneca Falls Declaration of Sentiments Resolutions প্রণীত হয়। এতে পুরুষের মতো নারীদেরকেও নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবি করা হয়। তবে তাদের দাবি কেবল ভোটাধিকারের মধ্যে সীমিত ছিল না বরং তারা শিক্ষা ও সম্পত্তির অধিকারে সমঅধিকার দাবি করে। কিন্তু এমনকি আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর সংবিধানের চতুর্দশ (১৮৬৮) ও পঞ্চদশ (১৮৭০) সংশোধনীতেও নারীদেরকে ভোটাধিকার দেওয়া হয় নি।
১৮৫১ সালে হ্যারিয়েট টেইলর মিল (Harriet Taylor Mill) লিখেছেন On the Enfranchisement of Women. এতে তিনি নারীশিক্ষা উন্নয়নের প্রস্তাব করেন এবং নারী সমাজকে অধস্তনে পরিণত করে এমন সব আইনগত ও রাজনৈতিক নিয়মকানুন পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন। ১৮৫৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্বামী জন স্টুয়ার্ট মিল The Subjection of Women (1864) রচনা করেন, যাতে টেলরের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে। এতে মিল পুরুষের মতো নারীদেরকেও সকল অধিকার প্রদানের প্রস্তাব করেন।
উনিশ শতকের শেষের দিকে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে নারীর ভোটাধিকারের দাবি নানা বেঁধে ওঠে। ১৮৯০ সালে আমেরিকায় National American Woman Suffrage: Association গঠিত হয়। ১৮৯৭ সালে ইংল্যান্ডে National Union of Women’s Suffrage Societies গঠিত হয়। কিন্তু ভোটাধিকার পেতে নারী সমাজকে আরো অনেক বছর আন্দোলন করতে হয়েছিল। অবশেষে আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও জার্মানির নারীরা প্রথম মহাযুদ্ধের পর এবং ফ্রান্সের নারীরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ভোটাধিকার লাভ করে। এভাবে ধীরে ধীরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারীরাও ভোটাধিকার পেতে থাকে
নারীবাদী আন্দোলন কেবল ভোটাধিকারের মধ্যে সীমিত থাকেনি বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সমঅধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালিত হয়। আমেরিকার ভোটাধিকার আন্দোলনের নেত্রী এলিস পল (Alice Paul) নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু তিনি ফ্লোরেন্স কেলির (Florence Kelley) সাথে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন নি। কারণ কেলি মনে করেন যে, পুরুষের সমঅধিকার নয় বরং কর্মজীবী নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অন্য সংস্কারপন্থী সংগঠনগুলোও একই যুক্তিতে কেবল সমঅধিকারের দাবির বিরোধিতা করে।
দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে নারীবাদী আন্দোলন উন্নতি লাভ করতে পারে নি। কিন্তু ১৯৪৯ সালে ফরাসি লেখক সিমোন দ্য বোভোয়ারের The Second Sex গ্রন্থ প্রকাশিত হলে নারীবাদী আন্দোলনে পুনরায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয় এবং নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম প্রবাহের (first wave) সমাপ্তি ঘটে। তিনি এই গ্রন্থে যুক্তি দেন যে, নারীর অধস্তনতার মূল কারণ কেবল রাজনীতি নয় বরং তা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে পুঁজিবাদী দেশগুলো কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে, যার আওতায় নারীদেরকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিক থেকে নারীবাদী আন্দোলনের নতুন যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার সাংবাদিক বেটি ফ্লাইডানের (Betty Friedan) The Feminine Mystique গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে Civil Rights Act পাস হয় যার দ্বারা ধর্ম, বর্ণ ও সেক্সের ভিত্তিতে চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য রহিত করা হয়। ১৯৬৬ সালে ফ্রাইডান ও অন্য মহিলারা National Organization for Women (NOW) গঠন করেন এবং ১৯৭০ সাল থেকে এই সংগঠন।
আরো পড়ুন : (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
নারীবাদের স্বরূপ ও পরিসর সংক্ষেপে আলোচনা করুন
নারীবাদ কী বা নারীবাদ কাকে বলে? নারীবাদের সংজ্ঞার্থ প্রদান করুন
নারীবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
নারীবাদের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা করুন
নারীবাদী তত্ত্ব কী? নারীবাদী তত্ত্ব কত প্রকার ও কী কী – আলোচনা করুন
নারীবাদের বিভিন্ন তরঙ্গ বা নারীবাদের ধারাগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করুন