নিম্নবর্গতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ : সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। প্রথম সাবলটার্ন স্টাডিজ সম্মেলন হয় ১৯৮৩-তে। এরপর বারো বছরের মধ্যে আট খণ্ড সাবলটার্ন স্টাডিজ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে ষষ্ঠ সাবলটার্ন স্টাডিজ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে যায় ১৯৯৮-এর জানুয়ারি মাসে লখনৌতে।
গত পনেরো বছরে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর লেখাপত্রকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চার মহল বেশ কিছুটা আলোড়িত হয়েছে। তার ঢেউ অন্যান্য সমাজবিজ্ঞান, এমনকি ভাষা-সাহিত্য- শিল্পচর্চার এলাকাতেও গিয়ে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, ভারতবর্ষ বা দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ-ইতিহাস চর্চার গণ্ডি ছাড়িয়ে সাবলটার্ন স্টাডিজ নিয়ে আলোচনা এখন বিশ্বের প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক ইতিহাসরচনার ক্ষেত্রেই শুনতে পাওয়া যায়। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঐতিহাসিক-সমাজবিজ্ঞানীরা অনেকে স্বতন্ত্রভাবে তাঁদের নিজস্ব সাবলটার্ন স্টাডিজ গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর মূল লেখাগুলো সকলে পড়ে থাকুন আর না-ই থাকুন, বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই ইতিহাস-সমাজবিজ্ঞান চর্চার মহলে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ এখন খুবই পরিচিত একটি নাম।
প্রথম সংকলনটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিরূপ সমালোচনাই শোনা গিয়েছিল বেশি। ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার প্রধান কেন্দ্রগুলির কর্তা ব্যক্তিরা ভারতবর্ষে, ইংল্যান্ডে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিকেরা অনেকেই সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর বিরোধিতায় মুখর হয়েছিলেন। সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর সঙ্গে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন এবং প্রথম সংকলনে যাঁদের লেখা ছাপা হয়েছিল, একমাত্র রণজিৎ গুহ ছাড়া অন্য সকলেই তখন নিতান্ত তরুণ এবং অপরিচিত লেখক। অনেকেরই প্রথম গবেষণার কাজ প্রকাশিত হয় সাবলটার্ন স্টাডিজ-এ।
সাবলটার্ন স্টাডিজের পর-পর তিন বছরে প্রথম তিনটি খণ্ড বেরিয়ে যায়। তার পাশাপাশি প্রকাশিত হয় ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ গোষ্ঠীর লেখকদের নিজস্ব গবেষণাগ্রন্থ-জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডের ‘দি অ্যাসেন্ডেন্সি অফ দি কংগ্রেস ইন উত্তর প্রদেশ’ (১৯৭৮), গৌতম ভদ্র-র ‘মুঘল যুগে কৃষি অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ’ (১৯৮১), ডেভিড হার্ডিম্যান-এর ‘পেজান্ট ন্যাশনালিস্টস্ অফ গুজরাট’ (১৯৮১), শাহিদ আমিন এর ‘সুগারকেন অ্যান্ড সুগার ইন গোরখপুর’ (১৯৮৪), পার্থ চট্টোপাধ্যায়-এর ‘বেঙ্গল ১৯২০- ১৯৪৭’, ‘দি লাভ কোয়েশ্চেন ‘ (১৯৮৪) এবং ডেভিড আর্নল্ড-এর ‘পুলিশ পাওয়ার অ্যান্ড কলোনিয়াল রুল’ (১৯৮৬)। এই পর্যায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই রণজিৎ গুহ-র ‘এলিমেন্টারি আসপেক্টস অফ পেজান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ (১৯৮৩)। ভারতবর্ষের ইতিহাসের লেখক-পাঠকদের সামনে প্রথম যে দুটি বিষয় উপস্থিত করে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ (১) ঔপনিবেশিক ভারতে উচ্চবর্গ এবং নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের স্বাতন্ত্র্য এবং (২) কৃষক চৈতন্যের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য—সেই দুটি বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বিশদ এবং তথ্যপূর্ণ আলোচনা করা হয় রণজিৎ গুহ-র বইতে। প্রথম পর্যায়ের সাবলটার্ন স্টাডিজ নিয়ে প্রবল বিতর্কের ঝড় ওঠে এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্ৰ করে।
গৌতম ভদ্র-র বইটি বাদ দিলে এইসব লেখাপত্র সবই ছিল ইংরেজিতে। কিন্তু প্রথম খণ্ড সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলা পত্রপত্রিকাতেও এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। ১৯৮২-তে রণজিৎ গুহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে বাংলায় দুটি বক্তব্য প্রদান করেন যা ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ শিরোনামে ছাপা হয়। এভাবেই ক্রমান্বয়ে দেশ হতে দেশান্তরে নিম্নবর্গতত্ত্বের বিকাশ লাভ করে।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
নিম্নবর্গতত্ত্ব কী বা নিম্নবর্গতত্ত্ব কাকে বলে?
নিম্নবর্গতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
নিম্নবর্গতত্ত্বের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা করুন