পরাবাস্তববাদের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ : পরাবাস্তববাদ শব্দটির ইংরেজি সুরিয়ালিজম। একে আবার অধিবাস্তবতাও বলা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময় যখন পরাবাস্তববাদ-এর উদ্ভব ঘটে, তখন ডাডাইজম-এর বিভিন্ন চিন্তাও এই মতবাদটির সাথে উপস্থাপিত হয়।
বিশেষত, ডাডাবাদী শিল্পীরা যে বাস্তবতাকে অস্বীকার করে উদ্ভট ও যুক্তিহীনতার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন; পরাবাস্তববাদ নিঃসংকোচে সেই ‘বাস্তব ও যুক্তিহীনতা’- কে গ্রহণ করেছিল। একই কারণে পুঁজিবাদী সভ্যতার ওপর ডাডাইজমের মতো পরাবাস্তববাদ ধারার শিল্পীদের বিরূপ ধারণা ও ক্ষোভ ছিল তবে সার্বিক বিষয় নিয়ে পৃথিবীর প্রতি তাঁদের একটা ইতিবাচক অভিব্যক্তির প্রকাশ পাওয়া যায়। শিল্প-সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের পর পরাবাস্তববাদ মতবাদ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
পরাবাস্তববাদ ধারার আদি পুরুষ ধরা হয় ফরাসি কবি গিয়োম অ্যাপিলিনিয়ারকে। তাঁর কবিতায় প্রথম পরাবাস্তববাদের প্রভাব দেখা যায়। তিনিই ১৯১৭ সালে ‘Surrealism’ শব্দটি পল ডিমি-র কাছে লেখা এক পত্রে প্রথম ব্যবহার করেন।
Surrealist শব্দটিও তাঁর দেয়া। তাঁর The Breast of Tiresias ‘ নাটকে অ্যাপোলিনিয়ার এ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। নাটকটি ১৯১৭ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হলেও ১৯০৩ সালে তিনি রচনা করেছিলেন। (বাংলা কবিতা, সুরিয়ালিজম তথা পরাবাস্তবতা: যাদব চৌধুরী)
সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, চলচিত্র প্রভৃতি শিল্পে এ আন্দোলন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও পরাবাস্তববাদ অনেক প্রভাবশালী। এ মতবাদটির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে ফরাসি কবি আন্দ্রে রেঁতো-র অবদান স্মরণযোগ্য। এই অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তাকে ‘দি পোপ অব সুরিয়ালিজম’ বলা হয়।
পরাবাস্তববাদের ইশতেহার প্রথম প্রকাশ করেন ইয়ানগল। ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর তিনি সেটি প্রকাশ করেন। প্রথম ইশতেহার প্রকাশের কিছুদিন পর দ্বিতীয় ইশতেহার প্রকাশিত হয়। অক্টোবরের ১৫ তারিখ আন্দ্রে ব্রেতো সেটি প্রকাশ করেন। ১৯৩০ সালে এই ধারার তৃতীয় ইশতেহার প্রকাশিত হয়। পরাবাস্তববাদ ধারার প্রভাবশালী দুই লেখক আন্দ্রে তেঁতো ও ইয়ান গল প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আলাদা দুটি দলে ভাগ হয়ে দু’দল সুরিয়ালিস্ট শিল্পীর নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ইয়ান গল-এর নেতৃত্বের অধীনে ছিলেন ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, ট্রিস্টান জারা, মার্সেল আর্লন্ড, জোসেফ ডেলাটল, পিয়েরে আলবার্ট প্রমুখ। আন্দ্রে ব্রেতো’র নেতৃত্বের অধীনে ছিলেন- লুই আরাগঁ, পল এলুমার্দ, রবার্ট ডেসনোস, জ্যাক বারোনব, জর্জ ম্যালকিন প্রমুখ। (সুরিয়ালিজমের জগৎ: মুহাম্মদ ফরিদ হাসান)
পরাবাস্তববাদের মূল বৈশিষ্ট্য অচেতন ব্যক্তির প্রকাশ। পরাবাস্তববাদী শিল্পের প্রকাশের এই রূপটি এমন বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে যা অযৌক্তিক, স্বপ্নের মতো এবং চমৎকার বলে মনে হয়, যেখানে পৌরাণিক কাহিনী, কল্পকাহিনী, স্বপ্ন এবং কল্পনা করা হয়। পরবাস্তবতার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ডাডাবাদ থেকে নেয়া হলেও এই মতবাদটি শিল্পের উৎস ও উপকরণ বিবেচনায় অন্যটির চেয়ে স্বতন্ত্র্য।
পরাবাস্তববাদ আন্দোলনের অগ্রগামী পুরুষ আন্দ্রে তেঁতো; তিনি শিল্প রচনায় অচেতন মনের ওপর গুরুত দেয়ার জন্য শিল্পীদের আহ্ববান জানান। তাঁর মতে, অচেতন মন কল্পনার অশেষ উৎস হতে পারে। তিনি এ ধারণাটি সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর কাছ থেকে পান। এ ধারায় চিত্রকল্প, ধারণা বা কাব্যিক কৌশল ব্যবহার করে মনকে মুক্ত করার ও পাঠককে চিন্তায় মগ্ন করার প্রচেষ্টা যোগানো হয়। এ কৌশলটি পাঠকদের নতুন সংযোগ তৈরি করতে এবং পাঠকের বাস্তবতাকে প্রসারিত করতে বা বাস্তবতা কি তা সম্পর্কে পাঠককে ধারণা করতে সাহায্য করে। মূলত পাঠককে সামাজিক প্রভাব থেকে মুক্ত করে ব্যক্তির মন উন্মুক্ত করার উপায় হিসেবে ফ্রয়েডীয় মুক্ত মেলামেশার ধারণাগুলোর দিকে আলোকপাত করা হয়। (দৈনিক জনকন্ঠ, ১৪ জানুয়ারি, ২০২০ )
ডাডাবাদী শিল্পীরা শিল্পের উৎস ও উপকরণ আহরণে অচেতন মনের ধারণার ওপর সচেতন ছিলেন না।
আন্দ্রে ব্রেতো মনে করতেন, যা বিস্ময়কর, তা সবসময়ই সুন্দর। অচেতন মনের গহীনেই বিস্ময়কর সুন্দরের বাস। সেটির সন্ধান করাই হতে পারে শিল্পীর যথার্থ কাজ। অচেতন মনের কারণেই মূলত শিল্পীরা গভীর অনুসন্ধানে নামেন।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
পরাবাস্তববাদ কাকে বলে? পরাবাস্তববাদের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন
পরাবাস্তববাদের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা করুন