Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

সাহিত্যে প্রকৃতিবাদের প্রভাব সম্পর্কে লিখুন বা প্রকৃতিবাদী সাহিত্য কর্মের পরিচয় দিন

ইংরেজী সাহিত্যে প্রকৃতিবাদী প্রধান প্রধান সাহিত্যিক

১.এমিল জোলা (১৮৪০-১৯০২): এমিল জোলাকে প্রকৃতিবাদের জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর প্রধান কাজ Genminal (১৮৮৫), Therse Raquin, The Experimental Novel (১৮৮০)। তাঁর Genminal (১৮৮৫) উপন্যাস কয়লাখনির অত্যন্তরে খনি শ্রমিকদের কীরুপ কর্মধারা কীভাবে কয়লা কাটায়, কীভাবে খনির রন্দ্রপথে জলের অনুপ্রবেশ ঘটে, ধ্বস নামে, যেমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত হয়েছে, তেমনি রক্তাক্ত খনি শ্রমিকের কর্মঘটের পুর্ণাঙ্গ চিত্রায়ন ঘটেছে। শ্রেণিসমাজে স্বাভাবিক তা প্রতিফলিত হয়েছে। সেকালের পটভূমিকায় পরিস্ফুট হয়েছে একটি রাজনৈতিক প্রগতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা শোষনে পিষ্ট খনি শ্রমিকদের বঞ্চনা ও আর্তনাদের অবিকল প্রতিচ্ছবি একেঁছেন। অগ্নিগর্ভ প্রতিবাদী খনি শ্রমিকদের প্রতিবাদী মিছিলের রুদ্ধশ্বাস বিবরণ দিয়েছেন। পাশাপাশি মালিক শ্রেণির অভ্যন্তরে একটা মানুষকে খুঁজেছেন। এক্ষেত্রে পরিবেশবাদ বা যথাযথবাদ অর্থাৎ আলোচ্য প্রকৃতিবাদের বৈশিষ্ট্যে অন্বিত উপন্যাসে বাস্তববাদের ডাইমেনশন বেড়েছে, তাও অগ্রাহ্য করা যায় না।

২. গি দ্য মোপাসাঁ (১৮৫০-১৯৩) : এমিল জোলা যেমন প্রকৃতিবাদী সাহিত্যের জনক কা অগ্রনায়ক তেমনি প্রকৃতিবাদের ভ্যানগার্ড বলা যায় মোপাসাঁকে। তাঁর কাজ ure vie (১৮৮৩), Bel – Ami (১৮৮৫), Pierr Jeam (১৮৮০) For Comme la mort (১৮৮৯) এই রচনাগুলোতে প্রকৃতি বাদের অজর উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে। স্বোপার্জিত ব্যাধি ও Melancholia’ য় অভিশপ্ত, ব্যাক্তিজীবন, ফলে নারী সম্পর্কে, সমাজের নানা স্তরের মানুষ সম্পর্কে, জীবনের সর্ববিষয়ে রুঢ় সত্য উন্মেচনই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর ইবষ-অসর তে যেমন ফ্রান্সের “অভিজাত সম্প্রদায়ের নৈতিক অধ:পাত” পূর্ণাঙ্গ রূপ পরিগ্রহ করেছে, তেমনি তার যন্ত্রনা দগ্ধ হৃদয়ের রক্তাক্ত প্রতিবিম্বন ঘটেছে, ‘চর্বির গোলা (Boul de suit) গল্পে। তাঁর অসংখ্য গল্পের মধ্যে একটি আনুবীক্ষনিক প্রক্রিয়ায় চরিত্রের উন্মোচনে বা রুপায়নে মোপাসাঁ প্রকৃতিবাদী ভূমিকায় নির্ধারিত হয়েছে। তাঁর গল্পে অবলীলায় ; তাঁর গল্পে অবলীলায় গণিকা পল্লী, গণিকা জীবন নীচুতলার সমাজ স্থান পেয়েছে। কিন্তু ফ্লাবেয়ার বা জোলার মধ্যে রোমান্টিক মানসতা প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন রূপে যদি ও বা পাওয়া যায়, মোপাসাঁর মধ্যে তা একান্ত দুর্লভ। ‘অবক্ষয়িত নাগরিকতা’ ও ‘মনোব্যাধির আচ্ছান্নতা’ হয়তো মোপাসাঁর গল্পকে প্রকৃতিবাদের অন্ত:সারে নিষিক্ত করে নেয়, তথাপি ছোটগল্পে তাঁর শিল্পচরিতার্থতা তলস্তয়ের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা সঞ্চারিত করেছে।

৩. স্টিফেন ক্রেস (১৮৭১-১৯০০): স্টিফেন ক্রেন একজন প্রকৃতিবাদের প্রবক্ত। তাঁর প্রধান কাজ ‘ম্যাগি’ ‘রাস্তার একটি মেয়ে’, ‘সাহসের লাল ব্যাজ’ (১৮৯৫), ‘সাহসের লাল ব্যাজ’ ক্রেনকে আন্তজাতিকভাবে বিখ্যাত করে। আমেরিকান আলোতে ক্রেনের প্রধান অবদান হলো তাঁর প্রকৃতি পরিক্ষা ‘দ্য রেড ব্যাজ অব কারেজ’ উপন্যাসে হেনরি ফ্লেমিংয়ের গল্প, একজন যুবক যিনি গৃহযুদ্ধে লড়াই তালিকাভূক্ত। এই আখ্যানে ক্রেন প্রকৃতিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রহণ করেন।

৪. জ্যাক লন্ডন (১৮৭৬-১৯৭৬) : তাঁর কাজ গুলো, ‘ওকল্যান্ড’, ‘ক্যালিফোর্নিয়া’, ‘পরের বছর’। প্রকৃতিবাদের দৃষ্টান্ত।

৫. ফ্র্যাঙ্ক নরিস/ বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন নরিস (১৮৭০-১৯০২) : আমেরিকার প্রকৃতিবাদের বিকাশকারী প্রধান লেখকদের একজন, জোলার মতে ফ্র্যাঙ্ক নরিসের কাজ বিশুদ্ধ প্রকৃতিবাদের কাছাকাছি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলি হল- ‘Mc teaque A story of san francisco’, ‘The octopus; A story of California’ and ‘The pit; A story of chicago’.

৬. থিওডোর ড্রেইজার (১৮৭১-১৯৪৫) : তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা ‘sister carrie’, ‘American tragedy’. প্রকৃতিবাদের যে কোনো আলোচনায় ‘An American tragedy’ এবং ‘sister carrie কে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

বাংলাসাহিত্যে প্রকৃতিবাদ :

সমাজবিকাশের ধারায় পুরোনো ও নতুন সমাজ ব্যবস্থার দ্বন্দো, ব্যবস্থার অন্তর্গত শ্রেণিদ্বন্দে যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটে, মূল্যবোধের রুপান্তরে অতীন্দ্রিয়তায় ঋদ্ধ রোমান্টিক রবীন্দ্রসাহিত্যের বিরোধিতায় বাংলা গল্প উপন্যাসে দখল নিল বাস্তবতা, অনিবার্য সূত্রে প্রকৃতিবাদ, যান্ত্রিক-প্রকৃতিবাদ ও বিষন্ন বাস্তবতা প্রকৃতিবাদ বালজাক, ফ্লাবেয়ার, জোলা, মোপাসাঁ সাদরে গৃহিত হয় বাংলা সাহিত্যে। যুদ্ধোত্তর কালের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সমস্যা, আশাহীনতা, জীবন-সম্পর্কে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি বিদ্রোহ দ্রুত গ্রাস করতে থাকে। প্রকৃতিবাদী সাহিত্য রচয়িতাদের সৃষ্টিসমূহ। এমিল জোলার ঘোষণাই যেন -…

১. অচিন্তাকুমার : ‘বেদ’, ‘বিবাহের চেয়ে বড়’, ‘প্রাচীর ও প্রানতর ;

২. জগদীশ গুপ্ত : রতি ও বিরতি অসাধু সিদ্ধার্থ

৩. বুদ্ধদেব বসু : এরা ওরা আরও অনেকে’, ‘রাত ভোরের বৃষ্টি’।

৪. তারাশঙ্কর : ‘হাসুলী বাঁকের উপকথা’ ।

৫. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’।

৬. বিভূতিভূষনের বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘অশনি সংকেত’ ; পঞ্চাশের মন্বন্তবের পটে লেখা দুর্ভিক্ষকাতর জীবনের নিখুঁত চিত্র অঙ্কন করেছেন।

৭. প্রেমেন্দ্রমিত্র : ‘বিকৃত ক্ষুবার ফাঁদে’; অপগত যৌবনা পতিতা জীবনের দুঃসহ এক বাস্তব চিত্র বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া সংসার সীমানতে’ তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা।

৮. নারায়ন গজ্ঞোপাধ্যায় : ‘টোপ’, ‘হাড়’, পয়সাওয়ালা মানুষের খেয়াল, বিলাস ও কামনাভোগের কাছে বিত্তহীন, ক্ষুৎপীড়িত মানুষের নিরর্থক হাহাকারের নির্মম আলেখ্য।

৯. শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় : তাঁর ‘কয়লাকুঠির’র গুল্পগুলি খনিজ শ্রমিক জীবনের প্রেম, বঞ্চনা, মালিকের ইন্দ্রিয় লালসা ও আত্মিক যন্ত্রনাহীনতার চমৎকার দলিল।

১০. সমরেশ বসু : ‘প্রজাপতি’, ‘বিবর’ উপরোল্লোখিত রচনাগুলি বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতিবাদের অন্যতম দৃষ্টান্ত।

সাধারণত একটি রচনায় মধ্যে, উগ্র বস্তুপ্রিয়তা, সরল বর্ণণাপদ্ধতি, নৈরাশ্য, মানুষের মনুষ্যত্বের অন্তরালস্ত জান্তব ধর্মের উন্মেচন খুঁজে পাওয়া যায় না এবং গেলে ও সে রচনার পাঠ্যগুণ থাকে না। তাছাড়া লেখকেরা যদি প্রতিমূহূর্তে পাঠকদের সচেতন করে দেন যে, মানুষের প্রতিটি ভোগ ও কর্ম পূর্বনির্দিষ্ট, ইচ্ছার স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, তাইলে ইবসেনের অসওয়ালেডর মতো অসহায় নিরপেক্ষভাবে পূর্বপুরুষের কৃতকার্যের যন্ত্রা ভোগ করতে হয় মাত্র। অসওয়ালেডর পরিণতি অঙ্কনে ইবসেন বংশগতি কে প্রধান্য দিয়েছেন ন্যাচারালিস্ট পদ্ধতিতে। এর ফলে প্রকৃতিবাদী লেখকেরা বাস্তব জীবন সমস্যার রূপ দিতে গিয়ে পাত্রপাত্রীর নৈরাশ্য ও আত্মিক যন্ত্রণাকেই পাঠকের একমাত্র প্রাপ্তি করে তুলেছেন। ন্যাচারালিস্টরা বিজ্ঞানের নিরপেক্ষতা দাবী করেন। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে গবেষককে নির্ধারিত লক্ষ্যে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব সত্য বলে ধরে নিতে হয়, অপ্রাসঙ্গিক তথ্য বর্জনও করতে হয়। অতএব বিজ্ঞানীকেও নির্বাচন করে নিতে হয় তবে গবেষণায় ও অগ্রসর হতে হয়। অন্যদিকে, একজন শিল্পীকেও প্রথমে ‘নির্বাচন’ অতঃপর ‘রূপায়ণ’ করার মাধ্যমে শিল্পরচনা করতে হয়। সুতরাং নিরপেক্ষ সত্য নিয়ে বিজ্ঞান হয় না সাহিত্য ও হয় না। তাই ন্যাচারালিস্টরা যে নিরপেক্ষতার মহিমা দাবী করেন তা যথাযথ নয়।

ন্যাচারালিস্টদের মধ্যে অনেকেই বিশুদ্ধ ন্যাচারালিস্ট ছিলেন না। তাঁরা ধীরে ধীরে প্রকৃতিবাদের কূল বৈশিষ্ট্য থেকে দূরে সরে গেছেন। যেমন তেইন ও পল বুরগেট ঝুঁকেছিলেন ধর্মের দিকে, ইবসেন-হাপ্টম্যান প্রতীকতা ও মিষ্টিসিজনের দিকে এবং স্ট্রিন্ডবার্গ নয়ারোমান্টিকতার পোষক হয়ে পড়লেন।

প্রকৃতিবাদে ন্যাচারালিস্টরা যেহেতু কোনো কিছুর হুবহু অনুকরণ করে, তাই অনেকেই একে ‘ফটোগ্রাফি’ বলে সমালোচনা করেছেন।

প্রকৃতিবাদ আন্দোলন অন্যান্য আন্দোলনের মতো স্থায়ীপ্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও শ্রমজীবীর জীবন রূপায়নে ছলনাভরা নীতিজ্ঞানের সমালোচনায় জীবন ও শিল্পের মধ্যবর্তী অবকাশ দূরীকরণে যে সাফল্য ন্যাচরালিস্টরা লাভ করেছিলেন, সাহিত্যের জগতে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সেই কারণেই।

আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)

প্রকৃতিবাদ কী বা প্রকৃতিবাদ কাকে বলে?

প্রকৃতিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করুন

প্রকৃতিবাদের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ

প্রকৃতিবাদী লেখকদের পরিচয় দিন

বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতিবাদের প্রভাব

সাহিত্যে প্রকৃতিবাদের প্রভাব সম্পর্কে লিখুন

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.