ক্লাসিসিজমের উদ্ভব ও বিকাশের ধারা : যথাবিহিত সাহিত্য সমালোচনা শুরুর আগে অ্যারিস্টোফেনিস (আনুমানিক 257-180 খ্রিস্টপূর্বাব্দ)- কৃত ‘Frogs’ নামক কমেডিতে সাহিত্য সমালোচনার উপাদান পাওয়া যায়। প্লেটো ও অ্যারিস্টটলই সর্বপ্রথম সাহিত্য সমালোচনা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন।
প্লেটো তার রিপাবলিক’ গ্রন্থে কাব্যকলা তথা শিল্পের প্রতি বিরূপতা প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, কাব্য পরম আদর্শের অনুকরণের অনুকরণ।কাজেই কাব্য দিয়ে আমরা সত্য অনুধাবন করতে পারি না। কাব্যে সুন্দরকে অনুকরণ করা হলে তা উৎকৃষ্ট, কিন্তু কাব্য অসুন্দরকে অনুকরণ করলে তা হবে ক্ষতিকর। প্লেটোর ধারণার বিরোধিতা করেন অ্যারিস্টটল। অবশ্য অ্যারিস্টটলও কাব্যকে অনুকরণ মনে করেন। কিন্তু তার মতে, এই অনুকরণ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি: অনুকরণে এবং সুর-সঙ্গতিতে মানুষ আনন্দ পায়। তবে অ্যারিস্টটলের কাছে অনুকরণে সত্যের মতো মিথ্যারও স্থান রয়েছে। তার মতে, কবির আকর্ষণ থাকবে অবিশ্বাস্য সম্ভবের চাইতে বিশ্বাস্য অসম্ভবের দিকে।
অ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব ‘ধ্রুপদী বা ক্লাসিক্যাল’ আদর্শ। তিনিই সমালোচনা পদ্ধতির জনক। অ্যারিস্টটল তার ‘পোয়েটিকস’ গ্রন্থে সাহিত্যতত্ত্ব সংক্রান্ত বিশদ আলোচনা করেছেন। কবির সৃষ্টিপ্রস্তুতি, কাব্য বিশ্লেষণ, কাব্যের শৃঙ্খলা ও বিন্যাস, কাব্যের শ্রেণিকরণ, কাব্যের ভূমিকা ইত্যাদি সম্পর্কে তিনিই প্রথম যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। অ্যারিস্টটলের মতে, ট্রাজেডি সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকল্প। কারণ এর রয়েছে সুসংহত সুবিন্যস্ত গঠন, দৃশ্যগুণ এবং শ্রব্যগুণ। তার মতে, প্লটই ট্র্যাজেডির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রোমান তাত্ত্বিক হোরেস (খ্রিস্টপূর্ব 65–) তার ‘আর্স পোয়েটিকা’ গ্রন্থের মাধ্যমে মূলত অ্যারিস্টটলের ধারণাকে তুলে ধরেন। অবশ্য তিনি গুরুত্ব দেন সুমিতিবোধ-পরিমিতিবোধের উপর। তাঁর মতে, কাব্যনাট্য হবে সুগ্রথিত, এর প্রতিটি অংশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ঐক্য থাকতে হবে। বিষয় নির্বাচনে চরিত্র সৃষ্টিতে, প্রকাশভঙ্গিতে সর্বত্র এই ঐক্য এবং সংগতি থাকবে।
ধ্রুপদী বা ক্লাসিক্যাল সমালোচনার চার পুরুষের সর্বশেষ হচ্ছেন ক্যাসিয়াস লঙ্গিনাস। তার সাহিত্যচিন্তার মূল কথা মহত্ত্ব (hypos, sublimity, great): এ মহত্ত্ব প্রকাশের, কালকে জয় করার, অনন্য রীতির মহৎ বিষয়ের ও চিন্তার। তার মতে, এই মহত্ত্ব অর্জনের উপায় পাঁচটি। যথা- নির্বাচন, পরিবেশ সৃষ্টি এবং উপস্থাপনার মাধ্যমে মহৎ ধারণা অর্জন করা: মহৎ আবেগ সঞ্চার করা: যথার্থ শৈলী এবং ধ্বনি ও অলংকার ব্যবহার করা; সুচারু ভঙ্গি, বাক্যাংশ সৃষ্টি, উপমা রূপকাদি ব্যবহার করা এবং কাব্যের গাঠনিক সংগতি সৃষ্টি করা। তার মতে, মহত্ত্ব হচ্ছে সৎ মনের প্রতিধ্বনি। চিন্তা যাদের সুগভীর সুস্থিত, মন যাদের উচ্চ, তাদের প্রকাশের সহজাত ভঙ্গিতেই প্রতিফলিত হয় মহত্ব’ ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “ক্লাসিক মানে একটি সর্বাঙ্গসুন্দরতার পারফেকশনের ফর্মে অচল প্রতিষ্ঠা।” পাশ্চাত্যের উল্লেখযোগ্য ক্লাসিক সাহিত্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ইলিয়াড’ : ওডিসি’ ‘প্যারাডাইস লস্ট’ ইত্যাদি। ভারতীয় সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে ‘রামায়ণ, মহাভারত’ ‘বৃত্রসংহার’ প্রভৃতি।
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
ক্লাসিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করুন
ক্লাসিসিজমের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ
ক্লাসিসিজমের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকদের পরিচয়